রাতের কপিল মুনির মন্দির |
কথায় আছে, “ সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার ”।
প্রশ্ন হল,
একবার কেন? বারবার নয় কেন? আসলে বেশ খানিক
অতীতে এই স্লোগানটি যথাযত
ছিল গঙ্গাসাগর এর ক্ষেত্রে।
কিন্তু ২০২২ এ এসে স্লোগানটি
প্রায় অচল। মানে খুব একটা প্রযোজ্য না। অতীতে গঙ্গাসাগর
যাওয়াটা বেশ কষ্ট সাধ্য ছিল।
তার আগে বলি ম্যাপ এ গঙ্গাসাগর
এর অবস্থান কিরকম। গঙ্গা নদী
(
হুগলী নদী)
আর বঙ্গোপসাগরের
মিলনস্থল একটি দ্বীপ। কপিল
মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে
একটি তীর্থস্থান। বর্তমানে
যেখানে মন্দিরটি অবস্থিত,
এটি আসল মন্দিরের অবস্থান না। বর্তমান মন্দিরটি আদি মন্দির স্থল থেকে প্রায় ২ কিমি দূরে অবস্থিত। এখানে রাম সিতা,
বিশালক্ষী,
হনুমান মন্দির,
শিব মন্দিরও আছে।
ভারত ভূখণ্ড থাকে আলাদা
একটা দ্বীপ। তাই এই দ্বীপে
পৌঁছাতে গেলে নদী সমুদ্র পার
হয়েই যেতে হবে। অতীতে নদী
সমুদ্র পার হবার সময়ই অনেক
রকমের দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা
গেছে। জল দস্যুদের হানা,
প্রাকৃতিক বিপর্যয়
ইত্যাদি। যারা বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা পড়েছেন তারা
বেশ কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন।
তবে বর্তমান সরকারের আমলে
সেই দূর্গমতা কাটানো গেছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নতি করেছে। প্রথমে ট্রেন
পথ তারপর ভেসেল কিংবা কলকাতা
থেকেই ক্রুজ এ করে সোজা গঙ্গাসাগর
যাওয়া যায়। এবারে তো গিয়ে
দেখলাম হেলিপ্যাড এর ব্যবস্থা
করা হচ্ছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে
উড়ে যাওয়া যাবে।
ম্যাপে গঙ্গাসাগরের অবস্থান |
গত শনিবার মানে নভেম্বরের ৫ তারিখ পরিবারের সকলে মিলে গঙ্গাসাগর ঘুরে এলাম। বাবা মায়ের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমরা ট্রেন ও ভেসেলের পথ বাতিল করে, মিলেনিয়াম পার্ক থেকে ক্রুজ এর পথ ধরে ছিলাম গঙ্গাসাগর যাবার জন্য। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার পথ। মিলেনিয়াম পার্ক থেকে ক্রুজ ছাড়ে আর গিয়ে পৌঁছায় কচুবেরিয়া ঘাট। তারপর ওখান থেকে কপিল মুনির আশ্রমে যাবার জন্য আবার একটা গাড়ি। সেটার সময় লাগে প্রায় ঘন্টা খানেক। সেখানে সাগর কটেজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। কটেজ থেকে বঙ্গোপসারের দূরত্ব পায়ে হেঁটে প্রায় ২ মিনিট আর কপিল মুনির মন্দিরের দূরত্বও প্রায় ২ মিনিট। পুরো জার্নি টাই বেশ মজার। আজকে সেটাই লিখবো।
ক্রুজ |
ক্রজ এর ছাড়ার সময় ছিল সকাল ১১:৩০। রিপোর্ট করতে হবে ১০:৩০ টায়। ঠিক সময়েই সবাই পৌঁছেছি। দেখি গুটি কয়েক লোকজন এবং তারা সবাই প্রায় ৬০ এর ঘরেই হবেন। ভাবলাম এদের সাথে যেতে হবে! ক্রুজে দুই রকমের সিটের বন্দোবস্ত। একটা প্রিমিয়াম আর একটা ইকোনমি ক্লাস। প্রিমিয়াম হল ক্রুজের সামনের সিট অর্থাৎ আপনি আর নদী মুখোমুখি। নদীর বুক চিরে আপনি চলে যাচ্ছেন এটা ভালোই বুঝতে পারবেন। আর ইকোনমি হল ক্রুজের পিছনের সিট যেখানে আপনি আর নদী পাশাপাশি। একটা খোলা দরজা দিয়ে দুটো ক্লাস ভাগ করা। পুরো ক্রুজটাই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। প্রিমিয়াম এ সিট সংখ্যা ইকোনমির সিট সংখ্যার থেকে বেশ কম। ওই যেমনটা হয় আরকি! দুই ক্লাসের মধ্যে ভাড়ার তফাৎ খুব বেশি না। প্রতি সিটে ইকোনমি ২,৪০০ (যাওয়া আর আসা মিলিয়ে) প্রিমিয়াম ২,৮০০ (যাওয়া আসা মিলিয়ে)। আমরা ইকোনমি ক্লাসে বুক করেছিলাম। ক্রুজে প্যাকেজ সিস্টেমে যাওয়া যায় আবার নাও যাওয়া যায়। মানে শুধু যাওয়া আর আসার ভাড়া দিয়েই যেতে পারবেন। প্যাকেজ সিস্টেমে, যাওয়া আসা,হোটেল, local transport (কোচুবেরিয়া ঘাট থেকে হোটেল) সবই দেবে। আমরা প্যাকেজ সিস্টেমে যাইনি। শুধু যাওয়া আর আসারটা নিয়ে ছিলাম। হোটেল এবং সাইট সিন করার জন্য গাইড নিজেরাই ঠিক করেছিলাম।
ইকোনোমি ক্লাস |
যথা সময়ে ক্রুজ ছাড়লো bye bye কলকাতা বলে। ভীষন সময়নিষ্ঠ এরা। একদম ১১:৩০ তে। আমার পরিবার আর বাকি দুজন ছাড়া বাকি সবাই প্রিমিয়াম ক্লাস। কি মজা! পুরো ইকোনমি ক্লাস ফাঁকা। যেখানে ইচ্ছে বসতে পারবো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়লাম সবাই। কিন্তু হায়! আধ ঘণ্টা যেতে না যেতেই প্রিমিয়াম ক্লাস ভিড় বাড়ালো ইকোনমি ক্লাসে। কারণ প্রিমিয়াম এ ভীষন ঠান্ডা। এটাই হয়! প্রিমিয়ামদের অবাধ বিচরণ সব ক্লাসে। সব জায়গায় দখলদারি। কিন্তু আমরা একবারও প্রিমিয়াম এ যাবার ইচ্ছে পর্যন্ত দেখাইনি চক্ষু লজ্জার খাতিরে! যাক তাও অনেক সিট ফাঁকাই ছিল। আমাদের কোন অসুবিধে হয়নি। ব্রেকফাস্ট দিল। দুটো রুমালি রুটি, ফুলকপির তরকারি আর শশা পেঁয়াজ কুঁচি সাথে চা। বেশ ভালো। খাওয়া সেরে অনেককেই দেখলাম মাথায় টুপি পরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে। এখানে একটা জিনিষ বলে রাখা দরকার যে এনারা বয়সে আমার ডবল হলেও এনার্জি কিন্তু দেখার মত। সবাই ভীষন excited, পেঙ্গুইনের মত করে সবাই দৌড়াচ্ছেন। বিশেষ করে মহিলারা। পেঙ্গুইনের মত দৌড় দেখে বুঝলাম সবারই হাঁটুর সমস্যা। আমার মায়েরও তাই। ওনাদের দেখে আমিও বেশ রোমাঞ্চিত হলাম। আমিও ক্রুজের ছাদে উঠলাম। দেখলাম সিঁড়ি বেশ খাড়াই। তবুও সবাই উঠছে। ওপরে দৃশ্য আরও রোমাঞ্চকর। এক তো হুগলী নদীর ওপর দিয়ে যাচ্ছি তারওপর একজন সত্তরোর্ধ্ব মহিলা শাহরুখ খানের স্টাইলে দুই হাত মেলে গান ধরেছেন " দিল তো পাগল হ্যায়, দিল দিবনা হ্যায় "! বাকিরা কেউ সেলফি আবার কেউ পতির সাথে সেলফিতে ব্যাস্ত। আনন্দমেলা! আমি দৌড়ে নিচে নেমে মা কে বললাম সবাই ওপরে উঠছে তুমিও উঠতে পারবে, চলো। বাপি তো আগেই তৈরি ছিল ছাদে বসে গঙ্গা দেখার জন্য। সবাই উঠলাম। বাপি, মা কে এত খুশি হতে খুব কম দেখেছি। বাপি বললো আমার একটা ফটো তোল, আমি চেয়ারে বসছি। বাপি কিন্ত এমনিতে ফটো তুলতে চায় না।
মিলেনিয়াম পার্কে টিকিট কাউন্টার |
নিচে নামার খানিক পর লাঞ্চ এলো। ভেজ ফ্রাইড রাইস, পনির বাটার মাসালা আর গুলাব জামুন একটা। খাবার পর কেউ ভাত ঘুম কেউ ছাদে উঠলেন। আমি দুটোর কোনোটাই করিনি। নিজের সিটে বসে নদীর সাথে, প্রকৃতির সাথে কথোপকথন চালিয়ে গেলাম। বিকেল প্রায় ৪:৩০ টায় কচুবেরিয়ায় আমাদের ক্রুজ নোঙর করলো। ডাঙায় আমাদের গাড়ি আমাদের অপেক্ষায় ছিল। এবার চললাম কপিল মুনির আশ্রমের দিকে। রাস্তার চারিদিক যতদূর চোখ যায়,সবুজ আয় জলাশয় এদিকে ওদিকে। প্রায় প্রতি বাড়িতেই মনে হয় একটা করে পুকুর আছে। অর্থনৈতিক অবস্থার যে কতটা দুরবস্থা তা আন্দাজ করা যায়। প্রায় ৪৫ - ৫০ মিনিট যাবার পর আমরা হোটেলে পৌঁছালাম। এই জায়গাটা একেবারেই অন্যরকম। সাগর আর মন্দিরের মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের হোটেল। মন্দির থেকে সাগরের দুরত্ব পায়ে হেঁটে ৫ মিনিট মত হবে। বেশ চওড়া ইঁট পাতা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে অস্থায়ী দোকান, হোটেল আর মাঝে মাঝে নারকেল গাছ।
গঙ্গাসাগরে স্বাগতম |
সন্ধ্যে ৭:৩০
থেকে মন্দিরে আরতি হবে।
তাড়াতাড়ি সবাই তৈরি হয়ে
চলে এলাম মন্দিরে। এক লাইনে
সকল ঠাকুরের অধিষ্ঠান। মাঝখানে
কপিল মুনি আর তার দুই পাশে রাম
সীতা,
হনুমান,
বিশালক্ষি,
মা কালি,
ইন্দ্রদেব,
নরসিংহ এর অধিষ্ঠান। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার,
কপিল মুনিকি
ঠাকুর?
না মানুষ?
না,
মানুষ কিন্তু
ঠাকুরের মত করে পুজো করা হয়?
জানি না। ঠাকুরদের
সামনে একটা কাগজে লেখা "
কঠোর ভাবে সেলফি
তোলা নিষিদ্ধ "।
কিন্তু সেটা কেউ মানছে না। কেউ দেখেছে বলেও তো মনে হয়
না। কিন্তু লেখাটা স্পষ্ট।
আমি আবার একটু নিয়ম মেনে চলা
মানুষ (সকল
ক্ষেত্রে নয় যদিও)।
আমি কিছুতেই ফটো তুলতে পারছি
না। আরতির ভিডিও করতেও পারছি
না। দিদি বললো সবাই করছে,
তাই আমরা করলে
দোষ নেই। কিন্তু কোথাও যেন
একটা বাধছে আমার। তাই দিদিই
ছবি তুললো। আমাদের বাঙালিদের
ঠাকুর আরতি যেরকম হয় ঠিক
সেরকম কোন ব্যাপার নেই।
পুরোহিতরা সবাই অবাঙালি।
কপিল মুনির সামনে যখন আরতি
করলো তখন শুধু একটা ডাবুর (কোন
অনুষ্ঠান বাড়িতে যে হাতা
গুলো ব্যবহার করা হয় রান্নার
জন্য)
মধ্যে আগুন নিয়ে
একজন ঘোরালো আর একজন চামর
নিয়ে বাতাস দিল। কোন মন্ত্র
পড়া হল না। তবে বাকি ঠাকুরদের
সামনে কিছু একটা মন্ত্র পড়া
হল। যার সুর আমাদের যেমন মন্ত্র
পড়ে সেরকম না। আরতি শেষে একজন
পুরোহিত সুন্দর ভাবে সুর করে
রাম সীতা রাম সীতা বলছিল আর
হাত দিচ্ছিল। সেটাকে আমরা
সকলে অনুসরণ করলাম।
হোটেল সাগর কটেজ , সাগর থেকে মন্দির |
ডালা দোকানের সামনে মূর্তি |
ঠাকুরদের ভোগ দেবার সময় হয়ে গেছে। এদিকে আমাদের পেটেও ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। রাজ্য সরকারের ফুড কোর্টে ঢুকলাম। খাবার ১১:৩০ টা থেকে পাওয়া যাবে। অগত্যা হোটেল। আমাদের গাড়ি এল ১১:৩০ টায়। হোটেল ছাড়লাম। আবার সরকারি ফুড কোর্টে। ওখানে থাকার ব্যাবস্থাও আছে। ১ হাজার টাকায় রুম। এসি গিজার সবের ব্যবস্থা আছে। আমাদের গাইড আগেই ওখানে খেতে বারণ করেছিল। কিন্তু ওখানটা বেশ পরিস্কার, ফাঁকা ছিল বলে আমরা ঢুকলাম। খাবার ভীষন বাজে। লোকজনের ব্যবহারও professional না। অতৃপ্ত পেট আর মন নিয়ে আমরা সাইট সিন করতে গেলাম।
সরকারি ফুড কোর্ট |
প্রকৃতি আমাদের মনে শান্তি এনে দিল। ওখানে দেখার জায়গা বলতে ইসকন মন্দির (এখনো তৈরি হচ্ছে), হেলিপ্যাড (এখনো তৈরি হচ্ছে), আয়লা বিধ্বস্ত এলাকা, লাইট হাউস, মনসা মন্দির, শনি মন্দির, নাগ সরোবর, আর কয়েকটা মন্দির।
শনি মন্দির, মনসা মন্দির |
নাগ সরোবর, বাসুকীদেব |
bye bye ক্রুজ |
সাগর কটেজে রুম বুক করার নম্বর
নাম :Milan Da
ফোন:+918116305212
ক্রুজে সিট বুক করার জন্য
Website: https://ospreyindia.com/
মিলেনিয়াম পার্কে গিয়ে offline এ টিকিট বুক করা যায়
যোগাযোগ :
9073380163, (Millennium Jetty 8274929297
19 N.S. Road, Standard Chartered Bank Building, 3rd Floor, Room No.18, Fairley Palace, Kolkata 700001
2 মন্তব্যসমূহ
Khub sundor hoyeche
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুনআপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে !