Ticker

6/recent/ticker-posts

একটা বাঁচতে শেখার গল্প : মুনিবা মাজারি

ইচ্ছাশক্তি যদি প্রবল হয়, কোন প্রতিবন্ধকতাই মানুষের জীবনে, তার উন্নতিতে বাধা হতে পারে না বা, বলা চলে জীবন যুদ্ধে সে কখনো পরাজিত হয় না। আজকে সেরকমই এক অপরাজিতার জীবন যুদ্ধে জয়ী হবার গল্প বলবো। প্রতিবন্ধকতা যে বারবার ইচ্ছাশক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে ,তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হল মুনিবা মাজারি পাকিস্তানের আয়রন লেডি

মুনিবা মাজারি, Muniba Mazari

তিনি একজন পাকিস্তানি মানবাধিকার কর্মী, একজন চিত্রশিল্পী, একজন টেলিভিশন উপস্থাপিকা, একজন মোটিভেশনাল স্পিকার এবং একজন গায়িকা। এক কথায় তিনি দশভুজা। বর্তমানে, তিনি, পাকিস্তানের ইউএন ওম্যানের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সালে, বিবিসির ১০০ সর্বাধিক অনুপ্রেরণামূলক নারীর মধ্যে নিজের স্থান করে নেন। ২০১৫ সালে বিবিসির সেরা ১০০ নারীর তালিকায় আসে তার নাম। ২০১৬ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনেও নাম আসে তার। কানাডা গ্লোবাল কনসাল্টিং এন্ড ট্রেইন্ট সেন্টার লিমিটেড (সিজিসি) কর্তৃক 'এক্সেলেন্স ট্রেইন সার্টিফিকেট' পুরস্কার পান ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে।

মুনিবা মাজারি, Muniba Mazari playing guitar

জন্ম মার্চ ১৯৮৭ সালে, এক রক্ষণশীল বালোচ পরিবারে। বাবা-মায়ের কথা মানতে মাত্র ১৮ বছর বয়সে,গ্রাজুয়েশন (ব্যাচেলর অফ আর্টস) শেষ করার আগেই বিয়ে করে নিতে হয়। বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। বিয়ের দু'বছর পর, যখন তিনি এবং তার স্বামী গাড়িতে করে বেড়াতে যাচ্ছিলেন তখন গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়। গাড়ি বড় একটি খাদে পরে যাওয়ার আগেই তার স্বামী লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে যান। কিন্তু মুনিবা বের হতে পারেনি। মারাত্মকভাবে তিনি আহত হন। ডান হাতের রেডিয়াস -আলনার হাড় ভেঙে যায়। হাতের কব্জি ভেঙে যায়। কাঁধের হাড়, কলারবোন, মেরুদন্ড প্রচন্ডভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়। বুকের অস্থি মজ্জা ভীষণভাবে ক্ষত হয় যার ফলে ফুসফুস লিভার দারুণভাবে ক্ষত হয়। শরীরে নিচের অংশটি সম্পূর্ণ প্যারালাইসড হয়ে যার সারা জীবনের জন্য।   

মুনিবা মাজারি, Muniba Mazari's accident

প্রায় আড়াই মাস ধরে বিভিন্ন ধরণের সার্জারি চলে। টাইটেনিয়াম দিয়ে ভাঙা হাত আর মেরুদন্ড জোড়া লাগানো হয়। ডাক্তার জানান, তিনি আর কোনোদিন ছবি আঁকতে পারবেন না। মা হতে পারবেন না। আর নিজের পায়ে কোনোদিন চলতেও পারবে না। আঁকতে পারবেন না, চলতে পারবে না তবুও ঠিক আছে। কিন্তু মা হতে পারবে না, সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না।  কারণ তিনি মনে করতেন একজন নারী তখনই  সম্পূর্ণ, যখন সে মা হয়। ভীষণ ভেঙে পড়েন। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন। একদিন তাঁর মা তাঁকে বললেন " তোমার এই অবস্থা একদিন কেটে যাবে। ভগবান নিশ্চই তোমার জন্য কিছু ভালো প্ল্যান করেছেন। যদিও আমি জানি না সেটা কি !" শব্দ গুলো তাঁর কাছে জাদুর মত লেগেছিল। মনে সাহস ফিরে পেলেন। ভাবলেন আমি যদি হতাশ হয়ে পড়ি তাহলে মা, ভাইয়েরাও হতাশ হয়ে পড়বে। সমস্ত যন্ত্রনা মনের মধ্যে চেপে রেখে হাসতে থাকলেন। ভাইদের বললেন কিছু রং আর ক্যানভাস এনে দিতে। ডাক্তারকে মিথ্যে প্রমান করে তিনি আবার আঁকতে শুরু করলেন। সমস্ত যন্ত্রনা,সুন্দর ছবি হয়ে ক্যানভাসে ফুটে উঠতে শুরু করলো।

মুনিবা মাজারি, Muniba Mazari at hospital

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আরও দু বছর বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন। তারপর হুইল চেয়ারে বসার মত শক্তি অর্জন করলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন সারাজীবন কারো সিমপ্যাথি নিয়ে ঘরের এক কোনে পরে থেকে বাঁচবেন না। অন্য কারো জন্য না, শুধু নিজের জন্য বাঁচবেন। প্রথমে নিজের ভয় গুলোর একটা লিস্ট বানালেন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন এই ভয় গুলো জয় করার জন্য। তাঁর প্রথম ভয় ছিল ডিভোর্স। ডিভোর্স দেবার কথা তিনি কখনোই ভাবতে পারতেন না। কিন্তু যখন তিনি বুঝলেন, এটা তাঁর ভয় ছাড়া আর কিছুই না, তখন নিজের সমস্ত আবেগকে চেপে রেখে নিজেকে বন্ধনমুক্ত করতে চাইলেন। দ্বিতীয় ভয় ছিল মা না হতে পারা। ভেবে দেখলেন, পৃথিবীতে এরকম অনেক বাচ্চাই আছে যাদের দায়িত্ব নেয়ার কেউ নেই। একজন সন্তানকে দত্তক নিলেন। মা হতে না পারার ভয়টাও সেদিন কাটলো।

মুনিবা মাজারি, Muniba Mazari with her son

এইভাবেই সব ভয় জয় করতে করতে আজ তিনি একজন চিত্রশিল্পী, একজন টেলিভিশন উপস্থাপিকা, একজন মোটিভেশনাল স্পিকার, একজন গায়িকা এবং একজন মানবাধিকার কর্মী হিসাবে পরিচিতি  পেয়েছেন বিশ্ব জুড়ে। তিনি প্রমান করে দিয়েছেন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা মানুষের ইচ্ছে পূরণে কোন বাধা হতে পারে না। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছিযারা শারীরিক ভাবে সুস্থ। কিন্তু তা সত্ত্বেও খুব সহজেই ভেঙে পড়ি আর আত্মহত্যার মত পথ বেছে নিই। খুব সহজেই হেরে যাই নিজের কাছে, পৃথিবীর কাছে। মুনিবা মাজারি সেইসকল মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার বিষয় হোক এটাই আশা রাখি।

মুনিবা মাজারি,Muniba Mazari with her painting







আরও পড়ুন :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ