CNCI রাজারহাট, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হসপিটালের ২ য় ক্যাম্পাস। এটা বর্তমানে temporary COVID হসপিটাল হিসাবে আছে। একটি ৭ তলা বিল্ডিং এ পুরোটাই COVID এর জন্য ব্যবহার হচ্ছে। যদি COVID পজিটিভ কেউ হন আর এখানে যদি কেউ ভর্তি হতে চান তাহলে www.wbhealth.gov.in এ গিয়ে কোরোনার হেলপ এর জন্য যে নাম্বার টা দেয়া আছে সেখানে কল করে জানালেই ওখান থেকে সব ব্যবস্থা করে দেবে। যদিও আমাকে এসব কিছু করতে হয়নি কারণ সব ব্যবস্থা অফিস থেকে করেছিল। আমি শুধু অ্যাম্বুলেন্সে করে এসেছি এখানে। তবে আমার এক পরিচিত এই ভাবেই ওখানে ভর্তি হয়েছেন। এবং ওনাদের কো- অপারেশন ভীষণ ভাবেই প্রশংসনীয়। যেহেতু এটি সরকারি COVID হসপিটাল তাই সমস্ত চিকিৎসা একদমই বিনামূল্যে দেয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য। ব্যাবস্থপনা ভীষণই ভালো। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অনেক ধন্যবাদ। অনেকেই বলেছিল বা কিছু ভিডিও বেরিয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে যেখানে বর্তমান সরকারের অনেক সমালোচনা করা হয়েছিল অব্যবস্থার জন্য, CNCI রাজারহাট সেটার একটা যোগ্য জবাব হতে পারে।
চার তলায় পৌঁছলাম। মেয়েদের ওয়ার্ডে ঢুকতেই, একটা খালি বেড দেখিয়ে এলিয়ানটি বললো এটা আপনার বেড আর একটা প্যাকেট বেডের ওপর রেখে দিল। দেখলাম একটা বিছানার চাদর (অবশ্যই বোম্বে ডায়িং এর না) আর একটা বালিশের কভার। ওগুলো সবই ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হয়। ঘরের সব আলো অফ করা। অনেকেই ঘুমাচ্ছেন। পাখা চলছে খুব ধীর গতিতে। রুমের বাইরে থেকে খানিক আলো আসছে আর দেয়ালের একদিকের খানিকটা কাচের হবার কারণে রাস্তার আলো ঘরে আসছে। ওয়ার্ডের বাইরে একটা ছোট ঘর আছে সেখানেও এলিয়ানরা ২৪ ঘণ্টাই ডিউটি দিচ্ছেন আর তার পাশেই আছে ছেলেদের ওয়ার্ড। যেকোন সময়ে যেকোন রকম অসুবিধে নিয়ে আপনি ওই ছোট ঘরটায় যেতে পারেন। সাথে সাথে সমাধান পাবেন। আমিও বিছানা গুছিয়ে নিজেকে গুছিয়ে গেলাম ওখানে। ভীষণ ঠাণ্ডা একটা ঘর। একজন এলিয়ান টেবিলের ওপারে বসে। পরে জানলাম উনি নার্স। সমস্যার কথা বললাম। সাথে সাথে ওষুধ দিলেন। ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। নতুন জায়গা তাই ঘুম আসছে না। তারওপর সবাইকে দেখে আমিও মুখে মাস্ক লাগিয়ে শুয়ে ছিলাম। মনে মনে ভাবলাম এইভাবে মাস্ক লাগিয়ে ঘুমোলে, COVID এ না মরলেও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অবশ্যই মরবো। অতএব মাস্ক খুলে ঘুমোলাম। ঘুম ভাঙলো সকাল পাঁচটায়। ঘুম ভাঙতেই দেখলাম কত অপরিচিত মুখ। কমবয়সী, সমবয়সী, বেশিবয়সী।
খাওয়া আর ঘুম ছাড়া আর বিশেষ কিছু কাজ নেই। পরিচিত কেউ না থাকার কারণে গল্প করার সুযোগও নেই। তাও এই সাত সকালে তো একদমই নেই। আর চুপচাপ বসে থাকার মানুষও আমি নই। তাই ঠিক করলাম ফ্লোর টা সরজমিনে তদন্ত করা যাক। আমাদের ওয়ার্ডটা চার খানা সেকশনে এমনভাবে ভাগ করা যেখানে সবাই সবাইকে দেখতে পাচ্ছে। কোন সেকশনে ৮ জন কোনোটায় ৭ জন এই ভাবে বেড পাতা। বেডের সাথে একটা খাবার টেবিল একটা স্যালাইনের স্ট্যান্ড একটা ড্রোয়ার আর অক্সিজেন দেবার ব্যবস্থা করা আছে। হলের একদম শেষের দিকে একটু সাইডে বাথরুম। এখানেও দুটো আলদা সেকশন এবং একেবারে আধুনিক। এবার ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে দু পা গেলে ডানদিকে একটা ছোট বাগান। এই সুবিধা একমাত্র চার তলার সাথেই আছে। বাকি তলা গুলোর সাথে এই সুবিধা নেই। তবে চাইলে যেকোন তলার মানুষই এখানে বেড়াতে আসতে পারে। বেশ সুন্দর। সকালে এই জায়গায় অনেকেই ব্যায়াম করেন কেউ শুধুই বসে থাকেন আবার কেউ কেউ প্রাতঃভ্রমণে ব্যাস্ত থাকেন। আর বিকেল হলে লোকজনের মেলা। সবাই আড্ডা দেয় এবং সেই আড্ডা রাত ১২টা পর্যন্ত চলে। শহুরে কোলাহল থেকে অনেক দূরে এইরকম একটা মনরম পরিবেশে নিজেকে আর অসুস্থ বলে মনে হয় না।
ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সকাল সাতটা। পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। বাড়িতে থাকলে একপালা খাবার খেয়ে ফেলি। আমার পাশের জনের ঘুম ভেঙেছে। বয়স ৬৩। আমাকে দেখেই বললেন কাল রাতে ঘুম হয়নি। ইনফ্যাক্ট কোন রাতেই তাঁর ঘুম হয় না ঠিক করে। এরপর আমার নারি নক্ষত্র জানলেন। নিজেরটাও জানলেন। খুব কম সময়েই বেশ ভালো একটা পরিচয় হয়ে গেল। ওনাকে দেখে মনে হল অনেকদিন পর একজন কথা বলার লোক পেয়েছেন। এমনিতে একজন শ্রোতা হিসেবে আমার নাম ভালোই বন্ধুমহলে। অনেক কথা বললেন কিছু কথা আবার একের বেশি বার বললেন। বয়স্ক মানুষদের সাথে কথোপকথনে আমি বেশ অভ্যস্ত। আমার ভালো লাগে। অনেককিছু জানা যায়। অনেক অভিজ্ঞতা ওনাদের। আর আমিও খানিক বাধ্য সন্তানের মত ব্যবহার করি ওনাদের সাথে। তবে সবার ক্ষেত্রে একটা কমন ব্যাপার দেখেছি। সবাই নিঃসঙ্গ! সবাই বাড়তি! যাদের কথা গুরুত্ব পায় না পরিবারে। অথচ এই পরিবার তার নিজের হাতে গড়া। যাক ঘরের সবারই একে একে ঘুম ভাঙছে। উনি সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই ওনাকে মাসিমা বলে ডাকছেন।
সাড়ে আটটায় বাইরে থেকে আওয়াজ এলো " খাবার নিয়ে যান "। ওহ্, কি শান্তি! প্যাকেট খুলতেই দেখি দুটো স্যান্ডউইচ আর একটা কলা। ফটাফট সাবার করে দিলাম। বাড়িতে থাকলেও এরকমই খাই। মজাই লাগলো। আদ ঘন্টা পর আবার ডাক " চা নিয়ে যান "। খেয়ে দেখলাম এটা ঠিক চা না। এলাচ, গোলমরিচ, দারচিনি, তেজপাতা আরো কিছু একটা দিয়ে বানানো। বেশ সুন্দর, চায়ের থেকে ভালো। এরপর একে অপরের মুখ দেখা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। বাকিরা আমার খোঁজ নিল আমিও বাকিদের নিলাম। পরিবেশটা বেশ বন্ধুত্বের মত লাগছিল। এবার আবার একটা ডাক। " একে একে ওষুধ নিয়ে যান "। ছোট ঘরটায় গেলাম। দেখলাম আমার নামের ফাইল তৈরি হয়েছে। পজিটিভ রিপোর্টের সাথে আরো কিছু কাগজ। সেখানে ডক্টর লিখে রেখেছেন আমার কি কি ওষুধ খেতে হবে। " কোন সমস্যা হচ্ছে? জ্বর এসেছিল? শ্বাস নিতে সমস্যা? গলা ব্যাথা? " না কোনোটাই আমার হচ্ছে না শুধু গলায় কফ্ জমছে। একটা অ্যান্টিবায়োটিক একটা অ্যান্টাসিড আর একটা কফ্ সিরাপ দিলেন। ঘরে এসে দেখি একটা বিষয় নিয়ে বেশ গভীর আলোচনা চলছে তবে সবার মুখেই বিরক্তির ছাপ। খানিক শোনার পর বুঝলাম বাথরুম নিয়ে ঝামেলা। কে পটি করে জল ঢালছে না, কে হিসু করে জল দিচ্ছে না, স্নান করার পর সেখানেই অনেক কিছু ফেলে নোংরা করে আসছে! গভীর সমস্যা। ভাবলাম কল খুললেই জল অথচ লোকে সেটা করবে না আর তারপর বলবে বাথরুম অপরিষ্কার।
বালতি, ঝাঁটা হাতে চারজন এলিয়ানের আবির্ভাব। দুজন বাথরুমে দিকে আর দুজন সুইচ বোর্ডের দিকে চলে গেল। পাখা বন্ধ করে আলো জ্বেলে ভালো করে ঘর পরিষ্কার করে দিল। আর কি একটা লিকুইড দিয়ে ঘর মুছে দিল। অসম্ভব বাজে একটা গন্ধ। কখনো মনে হচ্ছে ব্লিচিং আবার কখনো ফিনাইল। এবার ঘরের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হল " যাই স্নান করে আসি এখন বাথরুম পরিষ্কার করে গেল "। একজন আবার আরেকজনকে বলে দিলো " তোমার পর আমি "। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি, কারণ পরের দিন থেকে আমাকেও এইভাবেই থাকতে হবে। আজকের দিনটা শুধু অবজারভেশন। খানিক পর একজন এলিয়ান চিৎকার করতে করতে ঘরে ঢুকছেন " কার কি অসুবিধে আছে? ডক্টর এসেছে। " ঘরে উপস্থিত সকলেই ওনার দিকে চেয়ে আছি অদ্ভুত ভাবে। উনি বুঝতে পেরে বললেন " আমিই ডক্টর! কোন অসুবিধা আছে শরীরে ?" আসলে PPE তে কে ডক্টর, কে নার্স, আর কে যে সাফাই কর্মী বোঝা মুশকিল! গলার আওয়াজ, চলন বা কিছু ক্ষেত্রে অবয়ব দেখে কে ছেলে আর কে মেয়ে সেটা বোঝা যাচ্ছে ঠিকই তবে তাদের কাজ দেখে বুঝতে হচ্ছে কে কোন কাজের জন্য নিয়োজিত। যাক এটা খুব ভালোই বুঝলাম যে এই এলিয়ান গুলো ভালো এলিয়ান। আমাদের ভালো মন্দ দেখার জন্য এরা সমস্ত রকম ভাবে তৈরি। ধন্যবাদ ওনাদের।
স্নান করতে গিয়ে বুঝলাম চারিদিক কেন লোকে নোংরা করে রাখে। আসলে যারা এখানে আছেন তাদের বেশির ভাগটাই এই আধুনিক বাথরুমের সাথে পরিচিত না। তাই ঠিক করে ব্যবহার করতেও পারছে না। আর এরকম মানসিকতাও নেই যে অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেবে, কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। আর তাই নোংরা করে রাখছে। যদিও ২৪ ঘণ্টায় তিনবার বাথরুম পরিষ্কার করার জন্য লোক আসছে। স্নান করে এসে দেখি খাবার টেবিলে রাখা। অন্য কেউ তুলে রেখেছে। পরে জানলাম মাসিমা তুলে রেখেছেন। শুধু তাই না খাবার আসলে আর রুমে কোন একজন না থাকলে কিংবা কেউ ঘুমালে অন্যেরা তার খাবার তুলে রাখে। এই মানবিকতা বোধ মুগ্ধ করলো আমাকে। মজার বিষয় আমার পাশের সেকশনে কিন্তু এইরকম মানবিকতা বোধের বেশ অভাব দেখতে পাই। মেনুতে ভাত, একটা তরকারি, মাছের ঝোল, ডাল আর আচার। তবে এই তালিকা কিন্তু প্রতিদিন চেঞ্জ হয়। আবার রাত্রি নেমে এলো ঘরে। প্রায় সবাই ভাত ঘুম দিতে গেল। আমি ভাত ঘুমে অভ্যস্ত না। তাই এদিক - ওদিক, এটা - ওটা করে সারা দুপুর কাটলো। বিকেল হতেই আবার ডাক " টিফিন নিয়ে যাও " আবার সবাই লাইন দিয়ে টিফিন নিল। টিফিনে ডিম সিদ্ধ, কেক আর ভূজিয়া। আবার চায়ের ঘন্টা বাজলো খানিক পর। খাওয়া দাওয়া সেরে দলে দলে বাগানের দিকে চললো সবাই। নিমেষে ঘর ফাঁকা। মাসিমা আমাকে বললেন চলো একবার দেখে আসবে কত লোক।
সত্যি! এ যেন মেলা বসেছে! কত লোক চারিদিকে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গ্রুপ বানিয়ে গল্প করছে লোকে, কেউ একাই ঘুরছে গান শুনতে শুনতে। তবে সবার মুখেই মাস্ক এবং যতটা সম্ভব সামাজিক দূরত্ব মনার চেষ্টা করছে সবাই। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে উল্লাস চারিদিকে। সবাই কত খুশি। কারো মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া নেই। মাসিমা কে বললাম আপনি বসুন আমি একটু ঘুরে আসি। অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল এ রোগটা তো বেশ মজার। কোন এক অজ্ঞাত আত্মবিশ্বাসে সবাই আত্মবিশ্বাসী। হয় মরবে না হয় বাঁচবে। এর মাঝামাঝি কিছু নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঠিক যেরকম ডেসপারেট হয় লোকে, সব ভালো লাগা, খারাপ লাগা, ভয়, দুঃখ, সুখ কিছুই অনুভূত হয় না, ঠিক সেরকম মনে হচ্ছিল সবাইকে। পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনলাম " মেয়ের নামে বাড়িটা লিখেই দেব যদি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি "। তাকিয়ে দেখলাম ষাটোর্ধ্ব বয়স্কা। এক বয়স্ক একা একাই গান করে যাচ্ছেন। যাক এবার মাসিমার কাছে এসে বসলাম। আমাদের গ্রুপটা কাকিমা মাসিমা আর আমাকে নিয়ে পাঁচ জনের। পি এন পি সি ( পর নিন্দা পর চর্চা ) তে আমি খুব একটা অভ্যস্ত নই। তবে আমাদের গ্রুপে ওটাই বেশি হচ্ছিল। সত্যি বলতে বেশ মজাই লাগছিল। " ওই যে আমাদের ঘরের মেয়েটাকে দেখছ ওই ছেলেটার সাথে, ওরা কিন্তু কেউ কাউকে চিনতো না। এখানে এসে প্রেম করছে। বাড়িতে মেয়েটার বর বাচ্চা সব রয়েছে। এখন রাত বারোটা পর্যন্ত গল্প চলবে। জানি না বাবা কি করে এসব করে! এদের কি একটুও লজ্জা নেই! " এই টপিকেই বেশ বড় একটা চিন্তা দুশ্চিন্তা ভবিষ্যতবাণী চললো। আমি তখন ভাবছি অন্য কথা। সত্যিই রোগ টা বেশ মজার। মানুষের সাথে মানুষের প্রেমও করিয়ে দিচ্ছে! আবার রাত্তিরে খাবার ঘন্টা বাজলো।
সবে ঘুম ধরেছে। একটা গুঞ্জন কানে এলো। " নার্সকে ডাক, ওনার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে, এখনি অক্সিজেন দিতে হবে "। নার্স তখনই এসে সব ব্যবস্থা করে দিলেন, আঙ্গুলে অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন saturation level দেখে নিলেন। ওনার শ্বাসকষ্ট দেখে এই প্রথম মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখবার উপলব্ধি হল। সত্যিকারের মৃত্যু ভয় জাগলো মনের মধ্যে। আর কিছু ভাবতে চাইছিনা তখন। কোন রকমে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। একটু দেরি করেই সকাল হল পরদিন। উঠে দেখি ওনার বেড ফাঁকা। মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন নিচের ফ্লোরে ওনাকে আইসিইউ তে রেখেছে মনে হয়। চারিদিকের পরিবেশ খানিক স্বাভাবিক, যেন কিছু হয়নি। আমিও স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম। সকালে টিফিন খেয়ে আবার ওষুধ আনার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনেই হঠাৎ একজন পরে গেলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কি করবো কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছি না। নার্স দৌড়ে এলো। ছুটে এক বোতল জল নিয়ে এলাম। না উনি বেঁচে আছেন। কাপড় চোপড়ে পটি মাখামাখি। অনেক কিছুই বলতে চাইছেন কিন্তু কিছুই বলতে পারছেন না। কোনরকমে ওনাকে বেডে এনে শোয়ানো গেল। ডক্টর ওনাকে দেখে নিচের ফ্লোরে ট্রান্সফার করে দিলেন। এসব দেখে এক মুহুর্ত থাকার ইচ্ছে হচ্ছিলনা হসপিটালে। কিন্তু উপায় নেই। Adjust করতেই হবে কোনভাবে!
সারাদিন দুশ্চিন্তা আর অসহায় ভাবে কাটলো। শরীর তো দুর্বল ছিলই সাথে মনও যোগ দিল। সন্ধ্যে বেলায় দেখি একটা বাচ্চা মেয়ে, ওই ৯ কি ১০ বছর বয়স হবে, সে এলো ওই ফাঁকা বেডটায়। হায় ভগবান! এতটুকু বাচ্চা! সে এসে সেই যে ঘুমালো সারারাত তার কোন হুশ নেই। খাবার দিয়ে গেলে ডেকে উঠানো গেল না তাকে। কোনরকমে তাকিয়ে আবার নিস্তেজ! পরদিন সকালে দেখি বাচ্চাটি আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক। কথা বলছে। ডক্টর এলেন নামের লিস্ট নিয়ে। যারা সুস্থ হয়ে গেছে তাদের নাম একে একে ডাকলেন। মাসিমা দৌড়ে ওনার কাছে গিয়ে বললেন " আমার নাম আসেনি! আমার আর ভালো লাগছে না এখানে! " ডক্টর বললেন " আপনার তো প্রেসার আছে, ঘুমও হচ্ছে না, কয়েকদিন অবজারভেশন এ রাখবো আমরা। " এমনিতে ১০ দিন করে রাখার নিয়ম। মানে শেষের তিনদিন যদি জ্বর না আসে আর অক্সিজেন saturation level ৯০ শতাংশের ওপর থাকে তাহলে ১০ দিন রাখার পর ছেড়ে দেয়। আর নাহলে অবজারভেশন এ রেখে ওই দুটো criteria যদি fulfill হয় তাহলে ছেড়ে দেয়। লোকজনের সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়া দেখে মনে খানিক জোর পেলাম। আজকে সারাদিন বেশ গল্প আড্ডা দিয়ে কাটলো। রাতে মাসিমা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন " তুমি সন্ধ্যা মুখার্জীর গান শোন? " হ্যাঁ বললাম। সাথে সাথেই " কিছুক্ষন আরো না হয় রহিলে পাশে..." শুরু করে দিলেন। বেশ মজাই লাগলো।
পরদিন সকালে ডক্টর আবার লিস্ট নিয়ে এলেন। তাতে মাসিমার নাম ছিল। মাসিমার ছুটি হয়ে গেল। একটু ফাঁকা লাগছিল। কিন্তু বিকেল গড়াতে না গড়াতেই আরেকজন চলে এলেন ওই বেডে। বেশ চিন্তিত মুখ, তবে নিজের জন্য না। ওনার হাজব্যান্ড নিচের ফ্লোরে আইসিইউ তে ভর্তি আছেন। নিজের যত্ন নেয়া সাথে হাজব্যান্ডের। এইভাবে ওপর নিচ করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত। এসে শুয়ে পরেছেন। হঠাৎ ফোন এলো নিচে থেকে। দৌড়ে গিয়ে জানলেন ওনার হাজব্যান্ডের পাশের বেডের লোকটি মারা গেছেন এবং সেটা জেনে ওনার হাজব্যান্ড আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যাই হোক, রাতে ঘরে এসে হঠাৎই আমাকে বললেন " তোমার কাকুই একমাত্র রোজগেরে বাড়ির মধ্যে। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। কিছু যদি হয়ে যায় আমাদের সংসার পুরো ভেসে যাবে! " এই সময় ঠিক কোন বাক্যটা বললে ওনাকে যথেষ্ট সান্তনা দেয়া হবে, আমার জানা নেই। এটাও জানা নেই যে কিভাবে ওনার পাশে দাঁড়াবো। আসলে এসব ক্ষেত্রে কোন সান্তনা দেবার ভাষা থাকেনা বোধ হয়। চুপচাপ শুনে গেলাম! রাত্রি কাটলো। আমিও এরকম পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিচ্ছি। এইভাবেই কাটলো কয়েকটা দিন। কেউ বেশি অসুস্থ হয়ে নিচের ফ্লোরে চলে যাচ্ছে, কারো ছুটি হয়ে যাচ্ছে আবার নতুন লোক আসছে সেই শূন্য স্থান পূরণ করতে। অবশেষে একদিন সকালে ডক্টর এসে আমার নাম ঘোষণা করলেন। আমার ১০ দিন পূরণ হয়েছে এবং শরীরে কোন রকমের জটিলতা নেই। আমার ছুটি হল ওইদিন। বাড়িতে ফিরে আরো সাত দিনের isolation পিরিয়ডে থাকতে হবে। তারপর আবার টেস্ট করে, রিপোর্ট নেগেটিভ হলে আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো তবে অবশ্যই সাবধানে।
পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলছি, এখন জীবন যাত্রা অনেকই স্বাভাবিক হয়েছে। বাজার দোকান আগের মতোই সব খুলছে। কলকাতার রাস্তায় জনসমুদ্র নাহলেও ছোট খাটো নদীর দর্শন প্রতিদিনই হচ্ছে। একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে কোরোনা ভাইরাস কিন্তু এখনো ঘুরছে আমাদের চারপাশে। তাই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে আমাদের। জানি বারবার হাত ধোয়া বা sanitized করাটা একটু বিরক্তিকর কিন্তু তবুও যতটা সম্ভব করার চেষ্টা করতে হবে। অবশ্যই মাস্ক ব্যাবহার করতে হবে। ভিড় এড়িয়ে চলুন। প্রোটিন যুক্ত খাবার, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। প্রতিদিন শরীরচর্চা করতে হবে। বিশেষ করে শ্বাসের ব্যায়াম অবশ্যই করতে হবে। হসপিটালে ডক্টররা বারবার বলছেন শ্বাস কষ্টটাই মেন এই রোগের ক্ষেত্রে। জ্বর হলে একবার COVID টেস্ট করে নেয়াই ভালো। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন আপনারা।
আরও পড়ুন :
0 মন্তব্যসমূহ
আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে !