Ticker

6/recent/ticker-posts

আমি COVID -19 পজিটিভ ( পর্ব ১)

COVID 19, Rajarhar CNCI


রিসেপশনে বসে মশা মারছি। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা। সামনে তিনজন এলিয়ান খুব ব্যাস্ত হয়ে খাতা লেখালেখি করছে। "জমালয়ে জীবন্ত মানুষ" এর চিত্রগুপ্তের কথা মনে পড়লো। আসলে PPE (Personal Protective Equipment) পড়লে সবাইকে কেমন এলিয়ান বলেই মনে হয়। এতদিন আনন্দবাজারে " দৈনিক সংক্রমণের হার অমুক হাজার পেরোল, মৃতের সংখ্যা অমুক" পড়েই এসেছি আর আহা রে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি ! কখনও ভাবতে পারিনি ওই সংক্রমিত সংখ্যার মধ্যে আমিও একজন হব। চিন্তা শুধু মৃতের সংখ্যার মধ্যে ঢুকে না পরি ! বিকেল বেলাতেও শুধু এই আশায় ছটফট করেছি যে আমি নিশ্চই নেগেটিভ হব। এই প্রথম নেগেটিভ হবার আশা মনে সাহস যোগাচ্ছে। নেগেটিভ শব্দটা যে এতটা পজিটিভ অনুভূতি যোগায় তা এই প্রথম অনুভব করলাম।


সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায় একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসতেই মনে হল এই বুঝি আমার মৃত্যু দূত এসে হাজির। কাঁপা কাঁপা গলায় হ্যালো বললাম। ওদিক থেকে একটা ভারী কণ্ঠস্বর "আপনি অমুক বলছেন? আপনার COVID-19 টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ"! অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো " এইরে, আমাকে কি করতে হবে!" ওদিক থেকে "আপনি বাড়িতে থাকবেন না হসপিটালে যাবেন?" বললাম দেখুন, আমার মাথা কাজ করছে না, কোনটা ঠিক হবে বলুন তো ? বললেন, "ঠিক আছে আপনার ঠিকানাটা দিন, একটু পরে আবার ফোন করছি।" একবার মনে হল ব্যাপারটা কি মজার না? কোথায় মরবো তারজন্য আবার অপশনও দিচ্ছে। আবার একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন, একটি মহিলা কণ্ঠস্বর বেশ খানিকটা নরম। একটু ভরসা পেলাম। মৃত্যু দূতের কণ্ঠস্বর যে সবসময় কর্কশ এবং ভারী হবে তার কোন মানে নেই। ফোনের ওপার থেকে "আপনি অমুক বলছেন? জানেন তো আপনি পজিটিভ? আপনার কি কি অসুবিধে হচ্ছে?" বললাম জ্বর ছাড়া আমার আর কোন অসুবিধে নেই। "তাহলে আপনাকে CNCI রাজারহাটে দিচ্ছি।" যাক বাবা, বাঁচা গেল, কোথায় মরবো তার ডিসিশন আর আমাকে নিতে হল না! আবার একটি অচেনা নাম্বার। সেই ভারী কণ্ঠস্বর "কি ঠিক করলেন? কোথায় যাবেন?" বললাম ঠিক হয়ে গেছে, CNCI রাজারহাট। বললেন "ভালো করেছেন ওই হসপিটালটার ভালো রিপোর্ট আছে।" ভালো টা যে ঠিক কোন দিক থেকে বুঝতে পারলাম না! মিনিট দুই পর আবার একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন। সেই মুহূর্তে নিজেকে বেশ স্পেশাল মনে হচ্ছিল। "আপনি অমুক বলছেন? আপনার ঠিকানা টা বলুন? আমি অ্যাম্বুলেন্স থেকে বলছি। আপনার কি অক্সিজেন লাগবে?" বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম " না না আমার কিছু লাগবে না শুধু গাড়িটা পাঠান।" এখন আমি বেশ খানিকটা আত্মবিশ্বাসী। অবাক হবার ফেজটা কাটিয়ে উঠেছি। এখন আর ভয় লাগছে না। এবার আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করার সময় যে "আমি COVID 19 পজিটিভ।" অফিসে জানানোটা যতটা সহজ ছিল বাড়িতে জানানোটা ততটাই কঠিন। একবার ভাবলাম জানাবো না। তারপর ভাবলাম বাড়ির কোন একজনের জানাটা দরকার। একটা দুর্ঘটনা ঘটলে সমস্যায় পরবো। আমার ওপর ওদের এতদিনের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। 


" দাদা ঠিক ম্যানেজ করে নেবে ", এই বাক্যটা মনে মনে বলে, আমি সব রকমের রিস্ক নিয়েছি এখন পর্যন্ত, জীবনে। তাই দাদাকে বলাটাই খানিকটা সহজ ভেবে ফোন লাগালাম। As usually দাদাকে ফোনে পেলাম না। WhatsApp করলাম "আমি COVID পজিটিভ "। আবার অচেনা নাম্বার থেকে ফোন। "অ্যাম্বুলেন্স থেকে বলছি, আপনি রেডি হয়ে থাকুন, এক ঘণ্টার মধ্যে আসছি আমরা।" হৃদ স্পন্দন বাড়ছে ধীরে ধীরে। এদিকে দাদার WhatsApp "ফোন busy বলছে, কোথায় আছিস তুই?" দাদাকে টেনশনে দেখে আমার বেশ মজাই লাগলো। নিজেকে বেশ খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হল। দাদা সবসময়ই ভীষণ ব্যস্ত থাকে বাস্তবিক অর্থেই। সামান্য কিছুর জন্য ওকে ফোন করাটা, ওর "সময় নষ্ট" করছি বলেই মনে হয় আমার। এখন ওর ব্যাস্ত সময়ের কিছুটা  নিয়ে, ওকে টেনশনের মধ্যে ফেলে, বেশ একটা achievement এর অনুভূতি পেলাম। "কি হয়েছে বল, আসলে আমি একটা সেমিনারের মধ্যে ছিলাম" দাদার গলায় বেশ উদ্বিগ্ন এর স্বর। আমি তখন একদম কুল। বললাম রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে, অফিস থেকেই অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে দিয়েছে, গাড়ি আসছে আর বাড়িতে এখনি কিছু বলিস না, আমি পরে সব বলবো। "আমি একটু ব্যাস্ত আছি আসলে ব্লা ব্লা… আমাকে সব আপডেট দিবি, জামা কাপড় গুছিয়ে নিয়ে যাবি, কোথায় ভর্তি হচ্ছিস ডিটেইল দিবি আর যদি কিছু অসুবিধে হয় আমাকে জানাবি আমি উত্তম দা কে নিয়ে চলে যাবো" ফোন রেখে দিল। 


ভেবে দেখলাম কতদিন আর মা, দিদির কাছ থেকে লুকিয়ে রাখব। এইবেলাতে বলেই ফেলি যা হয় দেখা যাবে। মাকে দিয়ে শুরু করলাম। বললাম মন দিয়ে কথা শোন, আমার কোরোনা হয়েছে এখনই আমি হসপিটালে যাবো গাড়ি আসছে। কিন্তু চিন্তা করো না কারণ আমার সামান্য জ্বর ছাড়া আর কোন উপসর্গ নেই তাই তাড়াতাড়ি সেরে উঠবো। একটা সাধারণ জ্বরের মতই ব্যাপারটা। কোরোনা ভয় আমার তখন কেটে গেছে কিন্তু ভয় হচ্ছে মা যেন upset হয়ে না পড়ে। কারণ কোরোনা সম্পর্কে সমস্ত আপডেট টিভি থেকে দেখতে পায়। শুধু তাই নয়, এটাও মনে বিশ্বাস করে যে কোরোনা হলেই মানুষ মারা যাবে। আমার ওপর মায়ের অগাধ বিশ্বাস, ভরসা। আমি যা বলি সেটাই ঠিক। তাই কোনভাবে মাকে বোঝানো গেল যে আমি খুব খারাপ পরিস্থিতিতে নেই। বলা বাহুল্য, মাঝে মাঝে সবকিছু ঠিক রাখতে গিয়ে দু একটা মিথ্যে আমিও বলি, সেটা মা ভালোই জানে! গলা ভারী করে বললো "ফোন করিস, সবকিছু জানাস আমাকে"! বাপিকে নিয়ে খুব বেশি চিন্তা ছিল না। কারণ আমি জানতাম, বুঝিয়ে - সুঝিয়ে, বোকে - ঝোকে, মা ঠিক বাপিকে বুঝিয়ে দেবে যে ব্যাপার টা চিন্তার কিছু নয়। আর এরপর যেটুকু দুশ্চিন্তা থাকবে বাপির মনে সেটা আমার সাথে কথা বলে ঠিক হয়ে যাবে।


এবার সব থেকে কঠিন কাজ। দিদিকে ফোন করা। দিদির নলেজ আমার থেকে বেশি তাই দুশ্চিন্তাও বেশি। অনেক প্রশ্ন করবে আর তার উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে বিরক্ত হয়ে যাবো। গোঁজা মিল দেবার কোন উপায় নেই। ফোন করে খবরটা জানাতেই প্রশ্নের বাণ আসতে থাকলো। বুঝতেই পারছি দিদির দুশ্চিন্তার পারদ চড়ছে। কিন্তু আমিও জানি প্রশ্ন বানে আহত হবার আগেই আমাকে ক্ষেত্র থেকে প্রস্থান করতে হবে। তাই আমিও মোক্ষম অস্ত্র ছাড়লাম। বললাম স্বাস্থ্য ভবন থেকে, অ্যাম্বুলেন্স থেকে বারবার ফোন করছে। এখন কিছু বলতে পারছি না। পরে আপডেট দিচ্ছি। এরপর WhatsApp এ প্রশ্নের ভিড় জমতে শুরু করলো। "অ্যাম্বুলেন্স কখন আসবে? বাড়ি থেকে বেরোলে জানাবি, সব কিছু ঠিক করে গুছিয়ে নিবি, অ্যাম্বুলেন্সে কজন লোক থাকবে? ছেলে না মেয়ে? অ্যাম্বুলেন্সে উঠেই জানাবি, হসপিটালে পৌঁছেই জানাবি যত রাতই হোক এবং …?" 


মনাকে একবার জানানো দরকার। মনা আমার কলেজ জীবনের বন্ধু এবং আমার কাছের মানুষের মধ্যে একজন। ওকে জানালাম আর কিছু জিনিসপত্র আনতে বললাম। ও ভীষণ টেন্সড। ওকে ধরে আনতে বললে ও বেঁধে অনে। মানে একটা আনতে বললে কম করে দুটো আনবেই। হলোও তাই। ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র। সাথে আবার কয়েক হাজার টাকা। যাক এখন বকা ঝকা, ঝগড়া ঝাটি করার সময় নেই। দূর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললাম তুই যা আমি পরে তোকে সব আপডেট দেব। কিন্তু ও দাঁড়িয়েই থাকল। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। দু পা এগিয়ে আবার দাঁড়ালো। ওকে দেখে আমারই খারাপ লাগল। মনে হল আর হয়ত বেঁচে ফিরবো না। এটাই শেষ দেখা। বললাম আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, যা তুই। তারপর আমিই চলে এলাম আগে। 


সবকিছু গোছানো হয়ে গেছে। রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছি। অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষায় আছি। এইবার নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় পেলাম। এক মুহুর্ত মনে হল আর বুঝি কারোর সাথে দেখা হল না। হঠাৎ করেই কেঁদে ফেললাম। পরক্ষণেই মনে হল আমি নিশ্চই সুস্থ হয়ে যাবো। বুঝলাম নিজেকে সময় দেয়া যাবে না। তাই WhatsApp এর প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলাম। অ্যাম্বুলেন্স থেকে ফোন এলো। ওরা প্রায় চলে এসেছে। চোরের মত বাড়ি থেকে বেরোলাম। আসলে এটা এমন একটা রোগ, পাড়া প্রতিবেশী যদি জানতে পারে তাহলে অচ্ছুৎ মনে করবে। অতীতে কুষ্ঠ রোগীর মনের কষ্ট টা এখন অনুভব করতে পারছিলাম। বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরেই অ্যাম্বুলেন্স কে দাঁড়াতে বলেছি। রাত প্রায় দশটা। লোকজনও কম রাস্তায়। দুজন এলিয়ান গাড়ি থেকে নেমে এলো। অ্যাম্বুলেন্সে উঠেই দিদির সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম।


রাতের কলকাতা দেখার খুব শখ আমার। তবে অ্যাম্বুলেন্সে বসে দেখবো, এটা কখনো ভাবিনি। অ্যাম্বুলেন্সের জানলা খোলা। বেশ সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগছে। আবোল তাবোল ভেবে মনটাও ভারী হচ্ছে। জন্মের পর এই প্রথম কোন হসপিটালে ভর্তি হব। প্রথমবার মা সাথে থাকলেও এইবার আমি একেবারেই একা। একটা অচেনা জায়গা, কিছু অচেনা মানুষ, অচেনা বিছানা, অচেনা রোগ বলা ভালো মারণ রোগ। ইশ ভেবেই মনটা কেমন করছে। দুশ্চিন্তাদের পাত্তা না দেবার জন্য  ড্রাইভারকে বললাম, অ্যাম্বুলেন্স টা মজার গাড়ি বলুন? কোন সিগনাল মানতে হয় না, যেদিকে ইচ্ছে যাওয়া যায়, সবাই দেখে রাস্তা করে দেয়। "হ্যাঁ ম্যাডাম, অ্যাম্বুলেন্স চালানোর মজাই আলাদা, তবে কলকাতায় অনেকেই সাইড দিতে চায় না কিন্তু কেরালাতে গাড়ির হরেন শুনলেই সবাই রাস্তা পরিষ্কার করে দেয়। ওখানেও আমি গাড়ি চালিয়েছি।"  এই বলতে বলতে গাড়ির স্পীড আরো বেশি করলো। " ম্যাডাম, গাড়ি ধরে বসুন। রাতের খাবার না হলে পাবো না।" বললাম, চালাও ঠিক আছে তবে খেয়াল রেখো তোমার পক্ষীরাজ যেন আকাশে উড়ে না যায় ! মনে মনে বললাম আমার এখন সময় হয়নি, আকাশে ওড়ার। 


অবশেষে CNCI রাজারহাট পৌঁছলাম। একদম সেলিব্রেটি অভ্যর্থনা জানিয়ে একজন এলিয়ান আসুন আসুন বলে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল। আমার মতই বেশ কয়েকজন বসে আছে। একটা ফর্ম ফিলাপ করতে বললো। বেশ থমথমে পরিবেশ। চিত্রগুপ্ত একে একে নাম ডেকে তথ্য যাচাই করছে। এরই মধ্যে একটা পরিচিত মুখ। ছেলেটিকে COVID টেস্টের দিন দেখেছিলাম। খুব লাফাচ্ছিলো। বলছিল আমার কিছুই হয়নি, শুধু শুধু আমাকে টেস্ট করাতে পাঠিয়েছে। ছেলেটাই আমার দিকে এগিয়ে এলো। "কি অবস্থা?" এই তো চলে এলাম। তাহলে আপনিও পজিটিভ হলেন। ছেলেটি হাসলো। যাক একটা পরিচিত মুখ মনে সাহস দিল। বাঙালি জাত, কতক্ষন আর চুপচাপ বসে থাকবে! শুরু হলো গল্প। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকের সাথে পরিচয় হয়ে গেল। এখন সবকিছুই স্বাভাবিক লাগছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক এইসব চলার পর রাত ১২টায় বেড পেলাম। 4th floor, Bed number 452. এবার চললাম নিজের বাড়ি।

 

                                                                                                                                          

আরও পড়ুন :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. Wah.... Experience story ta experience korar motoi.. voy na aram laglo pore

    উত্তরমুছুন
  2. Sotti.... Erokom akta rog ke experience korte korte erokom halka rosikotar songe biboron dewata apnar asomvob sahosikotar o porichoy to dichhei sei songe pathokder rogtir proti voy tao komiye dichhe.... Apni khub taratari sustho hoe uthun. Anek anek shuvo kamona roilo.

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনার শুভকামনায় আমি এখন সুস্থ। ভালো থাকুন আপনিও...

      মুছুন

আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে !