খবরের কাগজ খুললে কিংবা সোশাল মিডিয়াতে বা বলা যায় ডিজিটাল দুনিয়াতে চোখ রাখলে দেখতে পাই, মেয়েরা প্রতিদিন, এই পৃথিবীর কোন না কোন জায়গায় লাঞ্ছিতা, নিগৃহীতা, ধর্ষিতা হচ্ছে পুরুষের দ্বারা। নিত্য এই লাঞ্ছনার ঘটনা এটাই বিশ্বাস করতে শেখায় যে, এটা একটা "স্বাভাবিক" ব্যাপার, অন্তত তৃতীয় বিশ্বের দেশে। তবে এই ঘটনার দায়ভার কিন্তু একা পুরুষের নয়। মেয়েরা এর প্রতিবাদ না করায়, আজকে ঘটনার এই ঘনঘটা! অন্তত আমার মতে তাই বলে। অনেক মেয়েরাই এটাকে জন্মগত সূত্রে পাওয়া অধিকার হিসাবে স্বীকার করে নেয়। আবার কেউ কেউ হেরে গিয়ে আত্মহত্যার মত অপরাধ করে বসে। খুব কমজনই আছে যারা প্রতিবাদ করে। আজকে সেরকমই একটা প্রতিবাদের গল্প বলবো। আজকে শোনাবো লাঞ্ছিতাদের ঘুরে দাঁড়াবার গল্প। এটি ঠিক গল্প না, গল্প হলেও সত্যি!
আফ্রিকার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অত্যাচারের কাছে বারবারই হার মানতে হত তাঁদের। কয়েক যুগ ধরে সহ্য করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। তাঁরা সম্বুরু উপজাতির মহিলা। নব্বুইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তাদের সহ্যের বাঁধ ভাঙলো, যখন তাঁরা ধর্ষিত হলেন একদল বিকৃত মন ও মস্তিষ্কের মানুষের হাতে। সমাজ থেকে বেরিয়ে এলেন ১৫ জন ধর্ষিতা। পুরুষ জাতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে, ঠিক করলেন পুরুষবর্জিত জীবন কাটাবেন। তৈরি করলেন একটি আস্ত গ্রাম। হ্যাঁ, একটি পুরুষবর্জিত গ্রাম। নাম দিলেন ‘উমোজা উয়াসো’। সোয়াহিলি ভাষায় ‘উমোজা’ শব্দের অর্থ ঐক্য আর উয়াসো হল উমোজা-র পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদী। এখানে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ না হলেও বসবাস নিষিদ্ধ।
কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে ৩৮০ কিমি দূরে সম্বুরু প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম 'উমোজা উয়াসো'। একটা সময় এই প্রদেশের মহিলারা নিদারুণ অত্যাচারিত, উপেক্ষিত হতেন সমাজে। সমাজে নিজেদের মতামতের গুরুত্ব থাকা তো দূরের কথা, পুরুষের সামনে কথা বলার মত অধিকারও ছিল না। অথচ বয়স্ক লোকের সঙ্গে বলপূর্বক বাল্যবিবাহ, যৌণ নির্যাতন ধর্ষণ ছিল নিত্য ঘটনা। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে নিদারুণ ভাবে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এই প্রদেশের মহিলারা। এই ঘটনার প্রতিবাদ করার অপরাধে তাঁদের গৃহত্যাগী হতে হয়। ধর্ষিত স্ত্রীর থেকে সংক্রমক ব্যাধির আশঙ্কায় তাঁদের স্বামীরা ঘর ছাড়তে বাধ্য করে তাঁদের এবং সমাজে কোণঠাসা করে দেয়। এইরকম অবস্থায় রেবেকা লোলোসলির নেতৃত্বে ১৫ জন সম্বুরু মহিলা উয়াসো নদীর তীরে গড়ে তুলেছিলেন মাতৃতান্ত্রিক গ্রাম ' উমোজা উয়াসো '।
এখন প্রশ্ন হতেই পরে, যে গ্রামে পুরুষের বসবাস নিষেধ সেখানে মেয়েরা কীভাবে পুরুষের সাহায্য ছাড়াই সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে ওখানকার এক বাসিন্দা বলেন, " আমাদের গ্রামে পুরুষের বসবাস নিষিদ্ধ, কিন্তু পুরুষ মানুষ আমরা পছন্দ করি "। তবে নিন্দুকেরা বলে, অন্য গ্রামে গিয়ে মেয়েরা তাদের পছন্দের পুরুষের সাথে যৌনমিলনে করে। এ ঘটনা যে সত্যি সেটা বিশ্বাস করতে মন চায়, যখন আর এক মহিলা বলেন, " আমার পাঁচজন সন্তান কিন্তু সন্তানদের বাবা কোন একজন পুরুষ নয় "। তবে এই প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর পাওয়া যায় নি।
রেবেকাদের চলার পথ কিন্তু একদমই মসৃণ ছিল না। সমাজে ব্রাত্য মেয়েদের এই ঠিকানা মেনে নিতে পারেনি সম্বুরু পুরুষেরা। শুধু তাই না, তারা মনে করে, পুরুষ হল সমাজের মাথা এবং মহিলা হল গলা আর মাথা কখনো গলার কাছ থেকে কোনো কিছুর জন্য অনুমতি নিতে পারে না। তাই তারা দ্বিগুণ প্রতিরোধের রাস্তায় নামে। উমোজার মহিলাদের সমস্ত কার্যকলাপ নজরবন্দী করার জন্য, নিজেরা একটি গ্রাম তৈরি করে উমোজার পাশেই। এরপর গ্রামের মেয়েদের উপার্জন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে, তারা একটা টুরিস্ট সেন্টার চালু করে যাতে ট্যুরিস্টদের উমোজা বিমুখ করা যায়। কিন্তু সেটায় সফল হল না তারা। তাই হতাশ হয়ে, কখনো গ্রামে গরু চুরি করেছে, কখনো গ্রামের নেত্রী কে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে এমনকি গ্রাম বন্ধ করার জন্য কোর্টে কেসও করে। কিন্তু রেবেকা লোলোসলির নেতৃত্বাধীন উমোজা গ্রামের মেয়েরা চরম বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে একে একে যাবতীয় বিপত্তি কাটিয়ে উঠেছিলেন। ২০০৯ সালে রেবেকার স্বামী সদলবলে গ্রামে আক্রমণ করে। কিন্তু সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয় রেবেকাদের মনোবল ভাঙতে। এবং একসময় তাঁরা পুরুষদের অধিকৃত গ্রামটি কিনে নিয়ে, খাতায় কলমে 'উমোজা উয়াসো' গ্রামের পরিধী বাড়াতে সক্ষম হন।
নিষ্ঠুর একপেশে সমাজকে পরাজিত করে, নিঃস্ব সম্বুরু মহিলাদের নিজেদের পায়ের নীচের জমি শক্ত করার যে সংগ্রাম তা, পৃথিবীব্যাপী লক্ষ লক্ষ অত্যাচারিতাদের মুখে ভাষা ফোটাক, মনে সাহস জাগাক। কুর্নিশ ওনাদের। মেয়েরা যে শুধুমাত্র "মেয়ে - মানুষ" না, তারাও আস্ত একটা মানুষ, এই ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।
0 মন্তব্যসমূহ
আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে !