Ticker

6/recent/ticker-posts

অসুর বধের পালা শুরু, উমোজা উয়াসো (Umoja Usao), কেনিয়া



উমোজা উয়াসো, Umoja Usao

খবরের কাগজ খুললে কিংবা সোশাল মিডিয়াতে বা বলা যায় ডিজিটাল দুনিয়াতে চোখ রাখলে দেখতে পাই, মেয়েরা প্রতিদিন, এই পৃথিবীর কোন না কোন জায়গায় লাঞ্ছিতা, নিগৃহীতা, ধর্ষিতা হচ্ছে পুরুষের দ্বারা। নিত্য এই লাঞ্ছনার ঘটনা এটাই বিশ্বাস করতে শেখায় যে, এটা একটা "স্বাভাবিক" ব্যাপার, অন্তত তৃতীয় বিশ্বের দেশে। তবে এই ঘটনার দায়ভার কিন্তু একা পুরুষের নয়। মেয়েরা এর প্রতিবাদ না করায়, আজকে ঘটনার এই ঘনঘটা! অন্তত আমার মতে তাই বলে। অনেক মেয়েরাই এটাকে জন্মগত সূত্রে পাওয়া অধিকার হিসাবে স্বীকার করে নেয়। আবার কেউ কেউ হেরে গিয়ে আত্মহত্যার মত অপরাধ করে বসে। খুব কমজনই আছে যারা প্রতিবাদ করে। আজকে সেরকমই একটা প্রতিবাদের গল্প বলবো। আজকে শোনাবো লাঞ্ছিতাদের ঘুরে দাঁড়াবার গল্প। এটি ঠিক গল্প না, গল্প হলেও সত্যি! 


আফ্রিকার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অত্যাচারের কাছে বারবারই হার মানতে হত তাঁদের। কয়েক যুগ ধরে সহ্য করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। তাঁরা সম্বুরু উপজাতির মহিলা। নব্বুইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তাদের সহ্যের বাঁধ ভাঙলো, যখন তাঁরা ধর্ষিত হলেন একদল বিকৃত মন ও মস্তিষ্কের মানুষের হাতে। সমাজ থেকে বেরিয়ে এলেন ১৫ জন ধর্ষিতা। পুরুষ জাতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে, ঠিক করলেন পুরুষবর্জিত জীবন কাটাবেন। তৈরি করলেন একটি আস্ত গ্রাম। হ্যাঁ, একটি পুরুষবর্জিত গ্রাম। নাম দিলেন ‘উমোজা উয়াসো’। সোয়াহিলি ভাষায় ‘উমোজা’ শব্দের অর্থ ঐক্য  আর উয়াসো হল উমোজা-র পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদী। এখানে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ না হলেও বসবাস নিষিদ্ধ। 


উমোজা উয়াসো, Umoja Usao, রেবেকা লোলোসোলি
রেবেকা লোলোসোলি

উমোজা উয়াসো, Umoja Usao
ইউনাইটেড নেশন হেড কয়ার্টার, ১০ই মার্চ,২০০৫

কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে ৩৮০ কিমি দূরে সম্বুরু প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম 'উমোজা উয়াসো'। একটা সময় এই প্রদেশের মহিলারা  নিদারুণ অত্যাচারিত, উপেক্ষিত হতেন সমাজে। সমাজে নিজেদের মতামতের গুরুত্ব থাকা তো দূরের কথা, পুরুষের সামনে কথা বলার মত অধিকারও ছিল না। অথচ বয়স্ক লোকের সঙ্গে বলপূর্বক বাল্যবিবাহ, যৌণ নির্যাতন ধর্ষণ ছিল নিত্য ঘটনা। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে নিদারুণ ভাবে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এই প্রদেশের মহিলারা। এই ঘটনার প্রতিবাদ করার অপরাধে তাঁদের গৃহত্যাগী হতে হয়। ধর্ষিত স্ত্রীর থেকে সংক্রমক ব্যাধির আশঙ্কায় তাঁদের স্বামীরা ঘর ছাড়তে বাধ্য করে তাঁদের এবং সমাজে কোণঠাসা করে দেয়। এইরকম অবস্থায় রেবেকা লোলোসলির নেতৃত্বে ১৫ জন সম্বুরু মহিলা উয়াসো নদীর তীরে গড়ে তুলেছিলেন মাতৃতান্ত্রিক গ্রাম ' উমোজা উয়াসো '।


২০১৫ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী ৪৭ জন মহিলা এবং ২০০ জন সন্তান নিয়ে রেবেকাদের বসবাস। পুত্র সন্তান কে বর্জন করা হয় না। তবে তারা প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই গ্রাম ছেড়ে দিতে হয়। তাই ১৮ বছরের ওপর কোনো পুরুষ এই গ্রামে বসবাস করতে পারে না। রেবেকা এবং তাঁর সঙ্গিনীরা ঠিক করেছিলেন, তাঁদের নতুন গ্রামে জায়গা হবে শুধুমাত্র সমাজে অত্যাচারিতাদের। সেই নিয়ম অনুযায়ী, আজও এই গ্রামে থাকতে পারেন সেই সব মেয়েরা-ই, যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে নিগৃহীতা হয়েছেন সমাজে।

এখন প্রশ্ন হতেই পরে, যে গ্রামে পুরুষের বসবাস নিষেধ সেখানে মেয়েরা কীভাবে পুরুষের সাহায্য ছাড়াই সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে ওখানকার এক বাসিন্দা বলেন, " আমাদের গ্রামে পুরুষের বসবাস নিষিদ্ধ, কিন্তু পুরুষ মানুষ আমরা পছন্দ করি "। তবে নিন্দুকেরা বলে, অন্য গ্রামে গিয়ে মেয়েরা তাদের পছন্দের পুরুষের সাথে যৌনমিলনে করে। এ ঘটনা যে সত্যি সেটা বিশ্বাস করতে মন চায়, যখন আর এক মহিলা বলেন, " আমার পাঁচজন সন্তান কিন্তু সন্তানদের বাবা কোন একজন পুরুষ নয় "। তবে এই প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর পাওয়া যায় নি।


উমোজা উয়াসো, Umoja Usao
রঙিন পুঁথি দিয়ে গহনা তৈরি

নিজেদের অর্থব্যবস্থা নিজেরাই গড়ে তুলেছিলেন। শুরুর দিকে, অন্য গ্রাম থেকে সব্জি কিনে বিক্রি করতেন কারণ নিজেরা চাষাবাদ জানতেন না। পরে পশুপালনের সাথে সাথে রঙিন পুঁথি দিয়ে কেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী গহনা তৈরি করে বিক্রি করতে লাগলেন পর্যটকদের। তাঁদের নিজস্ব একটি ওয়েবসাইটও রয়েছে যেখানে, নিজেদের তৈরি গহনা এবং ঘরসাজানোর নানা দ্রব্য অনলাইনে বিক্রি করেন। এক্ষেত্রে কেনিয়া সরকার তাঁদের সবসময় আশা যুগিয়েছে পাশে থেকে। গ্রামে পর্যটকদের ঢুকতে গেলে প্রবেশমূল্য দিতে হয়। অনলাইনে বুকিং করতে হয়। উমোজায় প্রবেশের আগেই সেই টিকিট এবং প্রবেশমূল্য জমা দিলে তবেই মেলে গ্রামে ঢোকার ছাড়পত্র। সবমিলিয়ে নিজেদের আর্থিক সংস্থান নিজেরাই করে নিয়েছেন। নিজেদের উদ্যোগেই নদীর পাশে ক্যাম্পসাইটের ব্যবস্থা করেছেন পর্যটকদের জন্য। যাতে 'উমোজা'তে ঘুরতে আসা পর্যটকেরা চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারে প্রাণ খুলে। তবে এখানকার প্রধান দর্শনীয় বিষয় হল নারীর অদম্য সাহসের একটা বাস্তব রূপকে চাক্ষুষ করা।

উমোজা উয়াসো, Umoja Usao
স্কুলের বাচ্চারা

উমোজা উয়াসো, Umoja Usao

গ্রামের শিশুদের জন্য স্কুল গড়ে তোলা হয়। শুধু মাত্র নিজেদের গ্রামেরই না, অন্য গ্রামের শিশুরাও পড়তে আসে এই স্কুলে। নতুন প্রজন্মকে জীবনের সাদা-কালো দিকগুলোকে চেনাবার শিক্ষা দেয়া হয়। যাতে, পরের প্রজন্মদের, মেয়েদের আর নির্যাতিতা হতে না হয়। গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের আয়ের ১০% দান করেন গ্রামীণ স্কুল ও উন্নয়ণ খাতে। ২০০৫-এ রেবেকা লোলোসলি নিজেদের জয়গাঁথা শোনানোর জন্য নিউ ইয়র্কে United Nations এ আমন্ত্রণ পান। বর্তমানে এঁরা আশেপাশের অঞ্চলে নারী অধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিও করছেন।

রেবেকাদের চলার পথ কিন্তু একদমই মসৃণ ছিল না। সমাজে ব্রাত্য মেয়েদের এই ঠিকানা মেনে নিতে পারেনি সম্বুরু পুরুষেরা। শুধু তাই না, তারা মনে করে, পুরুষ হল সমাজের মাথা এবং মহিলা হল গলা আর মাথা কখনো গলার কাছ থেকে কোনো কিছুর জন্য অনুমতি নিতে পারে না। তাই তারা দ্বিগুণ প্রতিরোধের রাস্তায় নামে। উমোজার মহিলাদের সমস্ত কার্যকলাপ নজরবন্দী করার জন্য, নিজেরা একটি গ্রাম তৈরি করে উমোজার পাশেই। এরপর গ্রামের মেয়েদের উপার্জন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে, তারা একটা টুরিস্ট সেন্টার চালু করে যাতে ট্যুরিস্টদের উমোজা বিমুখ করা যায়। কিন্তু সেটায় সফল হল না তারা। তাই হতাশ হয়ে, কখনো গ্রামে গরু চুরি করেছে, কখনো গ্রামের নেত্রী কে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে এমনকি গ্রাম বন্ধ করার জন্য কোর্টে কেসও করে।  কিন্তু রেবেকা লোলোসলির নেতৃত্বাধীন উমোজা গ্রামের মেয়েরা চরম বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে একে একে যাবতীয় বিপত্তি কাটিয়ে উঠেছিলেন। ২০০৯ সালে রেবেকার স্বামী সদলবলে গ্রামে আক্রমণ করে। কিন্তু সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয় রেবেকাদের মনোবল ভাঙতে। এবং একসময় তাঁরা পুরুষদের অধিকৃত গ্রামটি কিনে নিয়ে, খাতায় কলমে 'উমোজা উয়াসো' গ্রামের পরিধী বাড়াতে সক্ষম হন।


উমোজা উয়াসো, Umoja Usao
গ্রামের ঘর বাড়ি

নিষ্ঠুর একপেশে সমাজকে পরাজিত করে, নিঃস্ব সম্বুরু মহিলাদের নিজেদের পায়ের নীচের জমি শক্ত করার যে সংগ্রাম তা, পৃথিবীব্যাপী লক্ষ লক্ষ অত্যাচারিতাদের মুখে ভাষা ফোটাক, মনে সাহস জাগাক। কুর্নিশ ওনাদের। মেয়েরা যে শুধুমাত্র "মেয়ে - মানুষ" না, তারাও আস্ত একটা মানুষ, এই ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।


প্রতিবাদের হাওয়া, পরিবর্তনের হাওয়া সবার গায়েই লেগেছে আজকে। তবে নারী জাতির প্রতি আমার আশাটা বরাবরই বেশী। তাই আগামী দিনেও যেন এই ভাবে প্রতিবাদে গর্জে উঠুক নারী। যে সমাজ তাদের সম্মান দেয় না, যেখানে অনেক বেশী লাঞ্ছিত হতে হয়, সেই সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হোক। নিজেদের জায়গাটা শক্ত করতে হবে।




তথ্য ঋণ: আনন্দবাজার পত্রিকা, এইসময়, উইকিপিডিয়া, The Guardian


আরও পড়ুন :



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ