আফ্রিকা! নামটা শুনলেই মনের মধ্যে একটা রহস্য, রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার এর শিহরণ অনুভূত হয়! হবারই কথা। সেই ছোটবেলা থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখ দিয়ে আফ্রিকা দেখা শুরু করেছি। এরপর কত গল্প উপন্যাসে আফ্রিকাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। শুধু কি তাই? কত সব সত্যিকারের অদ্ভুত সব ঘটনার কথা শুনেছি, দেখেছি, পড়েছি ইন্টারনেটে। আজকে সেরকমই এক সত্যিকারের ঘটনা বা প্রচলিত প্রথা যা আজও ওখানকার মানুষ মেনে চলেছে অনেক উৎসাহের সাথে, সেটা জানবো।
আসল ঘটনা শুরু করার আগে বলে রাখি, সুন্দরী মেয়ে বলতে যে ছবি আপনার চোখে ভাসে, এই ঘটনা জানার পর সে ছবি কিন্তু একটু পরিবর্তন হতে পারে! কারণ মেয়েদের সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটা একটু আলাদা ওখানে। মৌরিতানিয়া! সরকারিভাবে যা একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র, উত্তর পশ্চিম আফ্রিকা মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। মেয়েদের সুন্দরী বানানোর বহু প্রাচীন একটি প্রথা এখনো প্রচলিত আছে এখানে। হ্যাঁ, ঠিকই দেখছেন। মেয়ে দের সুন্দরী বানানো হয় এখানে। লেবলোয় (Leblouh), একটা প্র্যাকটিস বা প্রসেসের নাম যার দ্বারা ৭ থেকে ১২ বছরের (মতান্তরে ১৯) মেয়েদের জোর করে খাইয়ে (force - feeding) সুন্দরী বানানো হয়। যে মেয়ে যত বেশি স্থূল হবে সে মেয়ে তত সুন্দরী হবে এবং স্বামী গৃহে সে অনেক বেশি সুলোক্ষণা হিসাবে পরিচিতি পাবে। ওখানকার পুরুষেরা স্থূল মেয়ে পছন্দ করে।
লেবলোয় (Leblouh) প্রাকটিস সম্বন্ধে একটু বলি। এটি এমন একটি প্রাকটিস যেটা সমাজে (যে সমাজ মানে যে স্থূল মেয়েরাই পরিবারে সুখ সমৃদ্ধি আনে) মেয়েদের বিবাহের সম্ববনাকে বাড়াতে সাহায্য করে। অল্পবয়সি মেয়েদের জোর করে খাইয়ে দ্রুত বয়ঃসন্ধির দিকে ঠেলে তাঁদের বেশি নারীসুলভ দেখানোর অমানবিক একটি প্র্যাকটিস। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই প্রথা প্রচলিত। এই সকল বাচ্চা মেয়েদের খাওয়ানোর দ্বায়িত্বে থাকেন একজন বয়স্কা মহিলা। যার কাজই হল এদের খাইয়ে শরীরের মেদ বৃদ্ধি করানো এবং তাদের পরিবারের থেকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক নেয়া। বাচ্চাদের, প্ৰচুর পরিমাণের ক্যালোরি জাতীয় খাবার খেতে বাধ্য করা হয় এবং কেউ খেতে না চাইলে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। কেউ যদি খেয়ে বমি করে ফেলে তাকে ওই বমি জোর করে খাওয়ানো হয়। শুধু তাই নয়, এই খাবার খাওয়ার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে কেউ যাতে পালিয়ে যেতে না পারে তারজন্য মরুভূমি তে (সাহারা মরুভূমি) একটা তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী আস্তানা বানিয়ে সবাই কে রাখা হয়। এবার বলি খাবারের পরিমাণ। একজন ছয় বছরের বাচ্চাকে ২০ লিটার উটের দুধ, দুকেজি ওজনের জোয়ার বা বাজরা সাথে দু কাপ মাখন খেতে হয় প্রতিদিন। বয়স অনুযায়ী এই খাবারের পরিমাণ পরিবর্তন হয়।
মৌরিতানিয়ার একজন মহিলা ( তখন তাঁর বয়স ১৪ বছর ) যিনি এই কুপ্রথার শিকার, তার কথা অনুযায়ী, একদিন তাঁর মা বলেন যে মরুভূমিতে একটা ভ্যাকেশন এ তাঁকে যেতে হবে এবং অনেক মেয়েরা আসবে ওখানে আর সবাই মিলে একসাথে কিছু ভালো খাবার খাবে। শুধু তাই না যখন বাড়ি ফিরে আসবেন তখন একজন সম্পূর্ণ সুন্দর মহিলা হিসাবে স্বীকৃতি পাবেন। আরো একজন মহিলা যিনি ওই একই বর্বর প্রথার শিকার তিনি জানান, শৈশব নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বেশ ভীতিপ্রদ৷ মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁকে তাঁর বাবা মা রোজ দু'বালতি পোরিজ খাওয়ানো শুরু করেন৷ কারণটা আর কিছুই না, যাতে শরীরের বিকাশ খুব দ্রুত হয় এবং পাত্রপক্ষ অতি সহজেই তাঁকে পছন্দ করেন৷ তিনি আরো জানালেন, রোজ তাঁকে জির্ক নামে একপ্রকার দুধ, জল এবং চিনির সমন্বয়ে তৈরি পানীয় খাওয়ানো হতো, যাতে তাঁর হজম ক্ষমতা বাড়ে৷ অতিরিক্ত মোটা বানানোর জন্য অধিক তেল, মাখন দিয়ে একটা আস্ত মেষ রান্না করে রাখতেন তাঁর মা৷ সারা সপ্তাহ ধরে তাঁকে সেটা খেয়ে শেষ করতে হত৷ এই জোরপূর্বক খাওয়ানোর পদ্ধতির সাফল্য হিসেবে তাঁর বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৩ বছর বয়সে৷ এক বছর পরে তিনি এক সন্তানের মাও হয়ে যান৷ কিন্তু চল্লিশে পা দিয়ে তিনি টাইপ টু ডায়বেটিসের শিকার, মাত্রাতিরিক্ত মোটা৷
এবার এই বর্বর প্রথার আরেকটি বর্বর দিক তুলে ধরছি। অল্পবয়সি মেয়েদের জোর করে খাইয়ে দ্রুত বয়ঃসন্ধির দিকে ঠেলে তাঁদের বেশি নারীসুলভ দেখানোর এই প্রথা বাল্য বিবাহেরই সমতুল৷ শুধু তাই না এর ফলে এখানকার মেয়েরা ডায়বেটিস, হার্টের অসুখ এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগতে শুরু করে৷ এই প্রথা মেনে চলার ফলে সমাজে নেমে আসছে অনেক সমস্যাও৷ যেমন, খরা বা অন্যান্য কারণে ফসল উৎপাদন কম হলে, মেয়েকে স্বাস্থ্যবতী গড়ে তোলার জন্য পরিবার শরণ নিচ্ছে রাসায়নিক পদার্থের৷ তখন কর্টিকয়েড বা স্টেরয়েড ধর্মী হরমোন যেগুলো সাধারণত পশুদের (স্থূল বানানোর জন্য ব্যবহৃত হয়) ওপর প্রয়োগ হয়ে থাকে সেগুলো জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে মেয়েদের চেহারার বাহ্যিক পরিবর্তন আনার আনার জন্য।
তবে মৌরিতানিয়ার শহরাঞ্চলে এই প্রথার প্রচলন প্রায় নেই। এখানে মেয়েরা এবং তাদের পরিবারের লোকেরা শিক্ষিত হচ্ছেন। তারা এই প্রথার বিরোধী। নিজেদেরকে সচল সক্ষম রাখতে মেয়েরা ছিপছিপে চেহারাতেই বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনও এই বর্বর প্রথার প্রচলন আছে। প্রার্থনা একটাই যে এই প্রথার প্রচলন বন্ধ হোক। মেয়েরা তাদের ইচ্ছে মত বাঁচুক।
2 মন্তব্যসমূহ
Valo laglo... New kichu jante pere ...besh onnorokom
উত্তরমুছুনধন্যবাদ! আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে আরো উৎসাহিত করলো।
মুছুনআপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে !