প্রতি বছর শীতের মরশুমে, আমরা সাতজন, এক বেলার জন্য হলেও কোন জায়গায় যাই পিকনিক করার অজুহাতে। তাই দফায় দফায় মিটিং করে, ইন্টারনেট সার্চ করে এবারের গন্তব্য ঠিক করা গেল। বিশ্রাম বাগানবাড়ি, টাকি।
একদিন রবিবার দেখে, সাতজন মিলে যাত্রা শুরু করলাম। ৭:৪০ এর শিয়ালদাহ - হাসনাবাদ লোকাল। বন্ধুদের সাথে গাড়ি করে দূরে কোথায়ও পিকনিক করতে যাওয়া বলতে যে ছবি চোখের সামনে ভাসে (সিনেমার সৌজন্যে ) , মানে, সবাই মিলে হই হুল্লোড়, গান - বাজনা করতে করতে যাওয়া, সেরকম কিন্তু একেবারেই হয়নি আমাদের সাথে। বরং খানিকটা উল্টো হয়েছে। কমিউনিকেশন গ্যাপ, আর তার জেরেই রাগারাগি, কথা না বলে চুপচাপ বিরক্তি প্রকাশ করতে করতে যাওয়া। অবশেষে টাকি যখন পৌঁছলাম, তখন সবাই বেশ হাসি খুশি। বিরক্তি রাগ সবই রাস্তাতে ফেলে এসেছি।
অবশ্য, বিরক্তি রাস্তায় ফেলে আসার কারণও যথেষ্ট আছে। ট্রেন শহর থেকে যত দূরে যাচ্ছে, চারিদিকে সবুজের বিস্তার বাড়ছে। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, গাছ - গাছালি। মাঝে মাঝে খাল - বিল দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, প্রকৃতি মা যেন খুব মন দিয়ে সাজিয়েছে চারিপাশ। এই সব দেখলে, রাগ বিরক্তি তো ভ্যানিশ হবেই।
টাকি স্টেশন থেকে খানিক দূরে বিশ্রাম বাগানবাড়ি। ওখানে পৌঁছনোর জন্য বাহন বলতে টো টো বা হাতে টানা ভ্যান। আমরা দুটো টো টো রিজার্ভ করে চললাম। মাঝে কচুরি আর তরকারি নিয়ে নিলাম (কারণ ওখানে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দেয়া ছিল না আমাদের)। সরু রাস্তা। দুদিকে গাছ গাছালি তে ভরা। ছোট গাছ, বড় গাছ, নাম না জানা অনেক গাছ। ইছামতি নদীর পাশ দিয়েই ওই রাস্তা। নদীর অন্য পাড়ে বাংলাদেশ। এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আমাদের টো টো বিএসএফ ক্যাম্প পেরিয়ে চললো গন্তব্যের দিকে। প্রায় পনেরো মিনিট চলার পর বিশ্রাম বাড়ি পৌঁছলাম।
চিত্র:বিশ্রাম বাগান বাড়ির প্রবেশ দ্বার |
পৌঁছেই হতাশ হলাম। আসলে যাত্রা পথে অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে, জায়গাটা সম্পর্কে একটা অন্যরকম ধারণা তৈরি করেছিলাম মনে। কিন্তু পৌঁছে দেখি বড় বড় গাড়ি আর বেশ কিছু কলকাতার বা শহুরে মানুষের ভিড়। ভেবে দেখলাম, এটুকুর সাথে একটু এডজাস্ট করতেই হবে। কারণ ওরাও তো এসেছে আমাদেরই মত সবুজের খোঁজে, শহুরে হট্টগোল দূরে।
বাগানবাড়ি কিরকম হয়, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। তবে এটুকু মনে হত যে, সেটা সাধারণ বসবাসের বাড়ি থেকে একটু আলাদা হবে। কিন্তু বাইরে থেকে এই বাড়ি দেখে সাধারণ বসবাসের বাড়ি বলেই মনে হল।
যে ঘরটিতে আমাদের বুকিং ছিল তার নাম " পুতুল রানীর ঘর"। পরে জানলাম ওই ঘরটি বাড়ির মালিকের মেয়ের। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে পুতুল রানীর ঘরে পৌঁছাতে গিয়ে দেখলাম এ যেন ঠিক বইতে পড়া জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে এসে গেছি। এখন বাড়িটিকে বেশ আলাদা রকমেরই মনে হল। একটু রেস্ট নিয়ে ডাইনিং এ ব্রেকফাস্ট করতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামলাম। প্ল্যান হল খাওয়া দাওয়ার পর জায়গাটি ভালো করে ঘোরার।
ডাইনিং থেকে বেরিয়ে সামনেই চোখে পড়লো একটা সান বাঁধানো পুকুর, দুইপাশে বসার জায়গা করা। পুকুরটি বেশ বড়, জলে হাঁস ভাসছে। পাড় বরাবর লম্বা লম্বা অনেক গাছ। একটু এগিয়ে দেখি একটা রঙচঙে পালকি রাখা। তার সামনে দুটো দোলনা। পুরো বাড়িটি গাছপালায় ঘেরা।
পালকি |
সূয্যি মামা পুকুরে ডুব দিয়েছেন |
গাছে ঘেরা বর্গক্ষেত্র পুকুর |
এই সেই বিসর্জন সিনেমাতে দেখানো টালির বাড়ি |
সিনেমাতে জয়া এহসানের বাড়ি |
ওখানে কিছুক্ষন থাকার পর আবার রুমে ফিরে এলাম। তারপর লাঞ্চ করলাম। তারপর প্ল্যান হল সাইড সীন করার। কিন্তু বন্ধুদের মধ্যে আবার মনোমালিন্য হল সাইড সীন করা নিয়ে। অবশেষে আর যাওয়া হল না। ট্রেন ধরে সোজা বাড়ি। আমাদের পিকনিকের শুরুটা মনখারাপ দিয়ে, শেষটাও তাই ! শুধু মাঝের টুকু, শুধুই ভালো লাগা ! এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম।
এবার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন এবং দরকারী তথ্য শেয়ার করি
যদি, বিশ্রামবাড়ি যাবার জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ওপর নির্ভরশীল হন তাহলে, টো টো নেবার সময় ভাড়া একটু যাচাই করে নেবেন। কারণ এমনিতে যা ভাড়া তার থেকে ডাবল চার্জ করেছিল আমাদের কাছে।
অতিথি আপ্যায়নের ব্যাবস্থাপনা খুবই হতাশা জনক।
ওখানকার খাবারের ওপর যদি নির্ভরশীল হন, তাহলে বলি, খাবারের মান এবং পরিমান নিয়ে বড় একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন আছে। খাবারের মান অতি সাধারণের থেকেও সাধারণ। আর পরিমানের কথা কি বলবো ! বালিগঞ্জের অফিসে, আপনি আগে থেকে যা অর্ডার দেবেন তার বাইরে যদি কিছু খেতে আপনার মন চায়, তাহলে, তার এক টুকরোও পাওয়ার আশা করবেন না ! এই ব্যাপারে "কিছু নেই " আর "হবে না " ছাড়া অন্য কিছু শুনতে পাবেন না!
লোডশেডিং হবার চান্স রয়েছে। তবে তার জন্য ব্যাকআপ ব্যবস্থা আছে।
থাকার জন্য রুম বেশ খানিকটা ভালো এবং বাথরুমও ভীষণ পরিষ্কার আর সমস্ত রকম আধুনিক সুবিধাও আছে।
বৈঠকখানা, আড্ডার বড় জায়গা, দীঘল পুকুরের ছাউনি দেওয়া ঘাট, মন্দিরের সামনে বসার জায়গা, গল্প করার জন্য ছোট ছোট কটেজ আছে।
যদি সাইড সীন করার ইচ্ছে থাকে তাহলে, ওখানে কিছু টো টো ড্রাইভার এমনিতেই থাকে। ওরাই আপনাকে নিয়ে যাবে। ইছামতী নদী, মিনি সুন্দরবন, মাছরাঙা দ্বীপ, পুরনো জমিদার বাড়ি ও মন্দির, গোলপাতার জঙ্গল প্রভৃতি দেখে আসতে পারেন।
সব মিলিয়ে (যদি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা এডজাস্ট করা যায়) বেশ ভালোই। যদি ফ্যামিলি নিয়ে একদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যেতে চান তাহলে, বিশ্রাম বাগান বাড়ি মন্দ হবে না। যদি বন্ধুরা মিলে পিকনিক করতে যেতে চান তাহলেও মন্দ হবে না। পিকনিক করার জন্য সমস্ত রকমের ব্যবস্থা করা আছে। আর যারা আমাদের মত রান্নার ঝামেলাতে যেতে চান না অথচ একবেলার জন্য কোথাও পিকনিক করার মজা নিতে চান, তাদের জন্য বেশ ভালো।
ভাড়ার বিষয়ে যারা জানতে চান : শিয়ালদা থেকে টাকি রোড ভাড়া ২০ টাকা। ওখান থেকে টো টো তে পঁচিশ টাকা। আর রুম ভাড়ার জন্য ওদের একটা ওয়েবসাইট লিংক দিচ্ছি। ওখানে আপডেটেড ইনফো পেয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
ভাড়ার বিষয়ে যারা জানতে চান : শিয়ালদা থেকে টাকি রোড ভাড়া ২০ টাকা। ওখান থেকে টো টো তে পঁচিশ টাকা। আর রুম ভাড়ার জন্য ওদের একটা ওয়েবসাইট লিংক দিচ্ছি। ওখানে আপডেটেড ইনফো পেয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
http://bisrambaganbari.com/bookingDetails.html
1 মন্তব্যসমূহ
Very informative , soon will plan for taki too..
উত্তরমুছুনআপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে !