Ticker

6/recent/ticker-posts

টাকের যত্ন নিন

টাকের যত্ন নিন, hair loss,
credit: wikipedia


সুমন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, "আর কোনো চিন্তা নেই। মেয়ে এবার আমি পাবোই।" আমি বললাম এ আবার কি কথা? কি এমন হল যে এত কনফিডেন্স?

"ডাক্তার দেখিয়ে এসেছি। বলেছে চুল গজাবেই।"

"মানে"?

"আরে তোমাকে বলেছিলাম না, চুল কম থাকার জন্য মেয়েরা পছন্দ করছে না। তাই একজন ভালো ডাক্তার দেখলাম। বলেছে একশো শতাংশ চুল গজাবেই।"

"চুল কম বলছিস কেনো? বল টাক পরেছে। টাক বলতে এত লজ্জা কিসের!"

"ও তুমি বুঝবে না! তোমার হলে বুঝতে।"


একবার নিজের মাথায় হাত দিয়ে বললাম, "এই দেখ কপাল দিন দিন বড়ো হচ্ছে, কিন্তু কপাল আর খুলছে না! এখন ডাক্তার দেখানো মানে, মাথা থেকে চুল যত না ঝরবে, পকেট থেকে তারও বেশি টাকা খসবে! মানে, কপাল তো খুলবেই না, বরং কপালে হাত পরবে।"


জয়ীতা কোথা থেকে টপকে পরে বললো, "কোথায় ডাক্তার দেখালি রে সুমন? আমিও দেখবো।"

আসলে জয়ীতারও একই সমস্যা। সামনে বিয়ে কিন্তু মাথার চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে। এবার দুজন শুরু করল টাক টক (Talk)।

ওদের কথা শুনতে শুনতে এটাই মনে হল যে, মাথায় টাক পড়াটা সত্যি একটা অনেক বড়ো সমস্যা ! ওদের মত করে ভাবিনি এতদিন। হ্যাঁ, তবে শ্যাম্পু করার সময় অনেকবারই ভেবেছি কিছুদিন পর নিশ্চই অভিনেতা ও পরিচালক অনুপম খের বা রাকেশ রশনের মত দেখতে হয়ে যাবো (মানে মাথাতে একটা চুলও থাকবে না, পুরো চকচকে একটি মাথা) তবে এই চিন্তায়, দুশ্চিন্তারা স্থান পায়নি কোনদিন বরং বেশ মজাই লেগেছিল। কারণ,সপ্তাহে চারবার চুলে শ্যাম্পু করা, conditioner লাগানো, দিনে দু তিনবার চুল আঁচড়ানো, চুলে তেল লাগানো এই সবকিছু থেকে মুক্তি এবং পকেটের সাশ্রয়। কিন্তু এবার দেখছি মাথার চুল উঠে যাওয়া নিয়ে seriously ভাবতে হবে।


চিত্র : অনুপম খের
চিত্রঋণ :superstarsbio.com

চিত্র:রাকেশ রশন
চিত্রঋণ :twitter.com 

এই টাক পরা নিয়ে seriously ভাবতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন মাথায় এল। আসলে কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে, আগে সমস্যা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকাটা দরকার। অতএব প্রশ্ন আর তার উত্তরের খোঁজে গুগল আর আমি মুখোমুখি হলাম।


টাক পড়া  কি এবং কেন টাক পরে?

উইকিপিডিয়া বলছে, টাক (ইংরেজি: Baldness) বলতে চুলের অভাবকে বোঝায়, বিশেষ করে মাথার চুল। মাথার চুল ক্রমাগত হালকা হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে সাধারণত টাক হওয়া প্রকাশ পায়। এটি পরিণত মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতিতে দেখা যায়। বৈজ্ঞানিকভাবে অ্যানড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়া (Androgenetic Alopecia), অ্যানড্রোজেনিক অ্যালোপেসিয়া (Androgenic Alopecia) ইত্যাদি নামে পরিচিত। টাকের পরিমাণ ও বিস্তৃতি অনেক বেশি হতে পারে এবং এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। তার মানে নারী-পুরুষ সমান সমান স্লোগান এই ক্ষেত্রে চলবে না। অতএব রাকেশ রোশনের মত আমাকে দেখতে হবার আশাতে জিজ্ঞাসা চিহ্ন পড়ল!

এবার আসি “কেন” প্রশ্নের উত্তরে। দিনে গড়ে প্রায় ১০০টির মতো চুল পড়া স্বাভাবিক এবং এটা প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটে। তবে এর বেশি চুল পড়তে থাকা মানে,আপনার কপালের বিস্তার ঘটতে চলেছে আর আপনি টেকো উপাধি পেতে চলেছেন।

প্রধানত দুটি কারণে টাক পড়ে। একটি জীনগত এবং আরেকটি ডাইহাইড্রোটেস্টোস্টেরন নামক এক প্রকার অ্যানড্রোজেন হরমোনের কারণে।

টাক পড়ার প্রক্রিয়া জানার আগে চুলের গোড়ার দিকে একটু নজর দেয়া যাক। আমাদের মাথার চুল তৈরি হয় মাথার চামড়ার নিচে থাকা হেয়ার ফলিকলনামের একটি গহ্বর সদৃশ অংশে। ওই অংশে চুল তৈরি হবার পর প্রায় ২ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত বাড়ে, তারপর প্রকৃতির নিয়ম মেনে কিছুদিন ওই বাড়া অবস্থায় থাকে এবং তারপর ঝরে পড়ে। এরপর সেখানে আবার নতুন চুল গজায় এবং চক্রটি আবার একইভাবে চলতে থাকে।


মানুষের শরীরের অভ্যন্তরীণ এনজাইমগুলোর ক্রিয়ার ফলে টেস্টোস্টেরন হরমোন পরিণত হয় ডাইহাইড্রোটেস্টোস্টেরনে। চর্মবিশেষজ্ঞ ও গবেষক কাটো মর্কের মতে, “এই ধরণের এনজাইমগুলো একজনের শরীরে কী পরিমাণে থাকবে সেটা বংশগত”। ডাইহাইড্রোটেস্টোস্টেরন এমন একটি হরমোন যা চুলের বৃদ্ধির স্বাভাবিক চক্রকে ব্যাহত ও ধীর করে এবং চুলগুলোকে ছোট ও পাতলা করে দেয় আর এর পাশাপাশি ঝরে যাওয়া চুলের জায়গায় নতুন চুল গজানোর প্রক্রিয়াকেও ব্যাহত করে।

এছাড়াও টাক পড়ে যাওয়া অনেকক্ষেত্রে নির্ভর করে মাথার ত্বকে কতগুলি রিসেপ্টর আছে তার ওপর। এই রিসেপ্টর যত বেশি হবে চুলও তত দ্রুত পড়বে।পর্যাপ্ত পরিমানে ডাইহাইড্রোটেস্টোস্টেরন এবং এটি তৈরিকারী এনজাইম থাকা সত্ত্বেও এগুলোর গ্রহীতা রিসেপ্টর যদি কম থাকে তাহলে মাথায় টাক পড়বে না।

চুল পড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় হেয়ার ফলিকলগুলোর ক্রমসংকোচনের ফলে।এই সংকোচনের ফলে ফলিকলগুলো স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক ছোট হয়ে যায় আর এখান থেকে গজানো চুলগুলোও হয় তুলনামূলকভাবে ছোট ও পাতলা। স্বাভাবিক চুলের চেয়ে তাড়াতাড়ি ঝরেও পড়ে এ চুলগুলো। এইভাবে ধীরে ধীরে ফলিকলগুলো এতই সংকুচিত হয় যে, তাতে চুলের কিছু অংশ গজায় ঠিকই কিন্তু তা আর মাথার ত্বক অবধি আসে না। ফলে মাথায় টাক পরা শুরু হয়।


চিত্র: টাক পড়ার বিভিন্ন স্টেজ
চিত্রঋণ:deshebideshe.com

কেন স্ত্রী অপেক্ষা পুরুষেরই বেশী ‘টাক’ ভোগ ঘটে?

অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়ার ভুক্তভোগী শুধুই পুরুষেরা এ ধারণাটা ভুল। তবে স্ত্রীদের ক্ষেত্রে পুরো মাথায় চুল পাতলা হয়ে গেলেও একেবারে টাক পড়তে সচরাচর দেখা যায় না। পুরুষরা বেশী ভুক্তভোগী কারণ,টেস্টোস্টেরন হরমোন, যা চুল পড়ে যাবার জন্য মূলত দায়ী।


চর্মবিজ্ঞানী কাটো মর্কের মতে, “যেহেতু পুরুষদের হরমোন টেস্টোস্টেরনের চুলের ওপর সর্বোচ্চ প্রভাব আছে, তাই মেয়েরা ঠিক পুরুষদের মতো চুল হারায় না।তবে মেনোপজের পরে মেয়েদের শরীরের ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যাবার কারণে, মেয়েদের শরীরে আগে থেকেই থাকা টেস্টোস্টেরন আরো বেশি সক্রিয় হয়ে চুল পড়ায় প্রভাব ফেলে। তবে পুরুষের মতো নির্দিষ্ট অঞ্চলে টাক পড়ার পরিবর্তে পুরো মাথায় চুলের ঘনত্ব কমে যাবার নজির পাওয়া যায়।

 টাকে চুল গজানোর উপায় কি?

প্রথমেই বলি, কোনো ফলপ্রসূ চিকিৎসা নেই যা আপনার মাথার ঘন চুলকে মরুভুমি হওয়া থেকে আটকাবে। তবে কিছু প্রচলিত পদ্ধতি আছে যেমন- ফিনাস্টেরাইডের মতো ঔষধ সেবন, মিনোক্সিডিল লোশনের ব্যবহার ইত্যাদি। তবে এগুলোর ব্যবহারের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি নানা বিরূপ প্রভাব ও ঝুঁকি রয়েছে। এগুলোর ফলাফলও খুব কার্যকরী নয় বরং ব্যবহার বন্ধে আবারও ফিরে আসবে টাক।


তবে যাদের পুরো মাথা জুড়ে টাক পড়ে না, মাথার পেছনভাগে কিছু চুল থেকে যায়, তারা এই মাথার পেছনভাগের চুল ও ত্বক নিয়ে মাথার অন্যান্য অংশে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টবা চুল প্রতিস্থাপন সার্জারির মাধ্যমে নিজের চুল ফিরে পেতে পারেন। টাক ঘুচিয়ে ফেলার একটা উপায় এটা।

চিত্র:চুল প্রতিস্থাপন সার্জারি
চিত্রঋণ:bbc.com

তবে এই প্রশ্নটি লিখে গুগল সার্চ করলে, অনেক ডাক্তার এবং অ-ডাক্তারদের (মানে যারা ডাক্তারদের ডাক্তারি করা দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে সদ্য ডাক্তার হয়েছেন) কাছ থেকে বহু প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উপায়ের কথা জানা যেতে পারে।

চুল প্রতিস্থাপনের নগরী

ইস্তাম্বুল শহরকে বলা হয় চুল প্রতিস্থাপনের নগরী। এখানে প্রায় তিনশো ক্লিনিক রয়েছে যেখানে চুল প্রতিস্থাপনের জন্য সার্জারি করা হয়। প্রতিবছর লাখ-লাখ মানুষ ইস্তাম্বুল নগরীতে আসে আট ঘন্টার এ অপারেশন করাতে।

চুল প্রতিস্থাপনের কাজটি কষ্টকর বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সূঁচহীন একটি যন্ত্রের মাধ্যমে প্রথমে জায়গাটি অনুভূতিহীন করে নেয়া হয়। এরপর মাথার পেছন থেকে চুলের গোঁড়ার অংশ সংগ্রহ করে যেসব জায়গায় চুল নেই সেখানে পুনরায় স্থাপন করা হয়। ভালো ফলাফল দেখতে হলে তাকে অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।

আমার মতে, এই শারীরিক সমস্যা কে সহজ ভাবে মেনে নেয়াই ভালো। এতে সময় আর টাকা দুটোরই সাশ্রয়, তাছাড়া অন্য কারও জীবনের অনুপ্রেরণাও হবারও একটা সুযোগ আছে। আমার মনে হয়, মাথা ভরা ঘন কালো চুল মানুষের বাইরের সৌন্দর্য বাড়ানো ছাড়া আর বিশেষ কিছুতে কাজে লাগে না। এটা সবসময়ই বিশ্বাস করি যে, মানুষের বাইরেটা তখনই সুন্দর হয় যখন মানুষের ভিতরটা সুন্দর হয় মানে তার মন, চিন্তা ভাবনা সুন্দর হয়।

 মাথার টাক কখনো ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে না। এর নজির ভুরি ভুরি আছে। বিদ্যাসাগর মশাই, গাঁধীজিসুভাষচন্দ্র বসু, শেক্সপিয়র ছাড়াও বহু বিখ্যাত ব্যক্তি আছেন যাঁদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে “টাক” কোন বাধা হয়নি। মনে হতেই পারে এগুলো অনেক বড় উদাহরণ কারণ সবাই তো আর অমন প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হন না। তবে চিন্তা বদলালে, চারপাশটাও বদলে যায়। এবার ভাবুন, টাক কে টাক হিসাবেই যত্ন নেবেন না, তাতে চুল গজিয়ে যত্ন নেবেন! সিধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।








কৃতজ্ঞতা স্বীকার : আনন্দবাজার পত্রিকা , বি বি সি বাংলা, দেশে বিদেশে 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে !